মার্সেলোর ছেলে এনজো; এনজোর বাবা মার্সেলো

২৮ মার্চ ২০২৩

মার্সেলোর ছেলে এনজো; এনজোর বাবা মার্সেলো

২০০৬ এর নভেম্বর মাস। ১৮ বছর বয়সী এক ব্রাজিলিয়ান ছোট্ট একটি ব্যাগে বড় আশা নিয়ে আসেন স্পেনে। রিও ডি জানেইরো থেকে মাদ্রিদে। সেই ফুটবলারটিই মার্সেলো।

রিয়াল মাদ্রিদে ১৬ মৌসুম কাটিয়ে এই লেফট উইং ব্যাক হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি। পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ জেতেন মোট ২৫ ট্রফি। ক্লাবের ১২০ বছর ইতিহাসে যা কোনো একজন ফুটবলারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। ৫৪৬ ম্যাচ খেলার পর গত মৌসুমে শেষ হয় মার্সেলোর রিয়াল মাদ্রিদ অধ্যায়। 

৩৪ বছর বয়সী মার্সেলোর বড় ছেলে এনজোও ফুটবলার। তবে বাবার মতো ডিফেন্ডার না; স্ট্রাইকার। বয়স মাত্র ১৩ বছর। রিয়াল মাদ্রিদ একাডেমীতে অনূর্ধ্ব-১৪ দলে খেলছেন এনজো। রিয়ালের একাডেমীতে ৯৯ ম্যাচে করেছেন ১০১ গোল। এই কিশোরের জন্য বাবা মার্সেলোর চেয়ে বড় আদর্শ আর কে হতে পারেন!

বাবা মার্সেলো ও ছেলে এনজোর সাক্ষাৎকার নিয়েছে ‘দ্য অ্যাথলেটিক’। রিয়াল মাদ্রিদের ট্রেনিং কমপ্লেক্স ভালদেবেবাসে। শুরুটা বাবার সাক্ষাৎকার দিয়ে। এরপর স্কুল থেকে এসে যোগ দেন ছেলেও। 

মার্সেলো রিয়াল মাদ্রিদে এসে সই করলেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিপ্রশ্ন: শুরুতেই মাদ্রিদের হয়ে মার্সেলোর শুরুর দিনগুলোর দিকে যদি ফিরে তাকাতে বলি?

মার্সেলো: শুরুতে খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণ রিয়াল মাদ্রিদে এসে আমার যে ঠিক কী হবে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম না। একটি কম্পিউটার এবং অল্প কিছু জিনিস নিয়ে আমি প্রথম এখানে আসি।

শুরুতে বলা হয়েছিল, রিয়াল মাদ্রিদের ট্রেনিং সেন্টার ও স্টেডিয়াম দেখে একটা ধারণা পাওয়ার জন্য আমি এসেছি। পরে বুঝতে পারি যে, আমাকে আর ব্রাজিলে ফিরে যেতে হবে না। বলা হয়, তাহলে চুক্তিতে সই করাটাই ভালো। রিয়াল মাদ্রিদের এসেছিলাম স্টেডিয়াম ঘুরে দেখার জন্য। কিন্তু এখানে এসে সই করলাম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। 

ভিডিও গেম অবা টিভিতেই শুধু রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়দের দেখেছি। তখন ভাবতাম ‘লস গ্যালকতিকোস’ বলে সত্যি কিছু নেই। তাঁদের চোখের সামনে দেখে রীতিমত ধাক্কা খাই। এরপর পরিবার ও বন্ধুদের কাছে গিয়ে যখন বলি, ‘আমি একে দেখেছি, ওকে দেখেছি, তাকে দেখেছি, রিয়াল মাদ্রিদের সব তারকাকে দেখেছি’ সবাই হাসে। আমিও সে হাসিতে যোগ দিই। এরপর ধীরে ধীরে বিষয়গুলোর সাথে অভ্যস্ত হই। 

প্রশ্ন: সেই সময়ের ওই তরুণ মার্সেলোকে আপনি এখন কী পরামর্শ দিতে চাইতেন?

মার্সেলো: সত্যি বলতে, কিছুই বলব না। আমি যখন রিয়াল মাদ্রিদে আসি, অসাধারণ সব ফুটবলার এখানে ছিলেন। শুধু খেলার মানে নয়, মানুষ হিসেবেও। বিশ্বাস ছিল, তাঁদের অনুসরণ করলে আমিও ফুটবলের গুরুত্বপূর্ণ কেউ হতে পারব।

রিয়াল মাদ্রিদে তখন ছিলেন রাউল। সের্হিয়ো রামোস আমার মাত্র দেুই বছরের বড় হলেও সে তখনই অধিনায়ক হয়ে যায়। রবের্তো কার্লোস, রুদ ফন নিস্তলরয়, ডেভিড বেকহাম, মিশেল সালগাদোসহ আরও অনেক দুর্দান্ত খেলোয়াড়। আমার সামনে ভালো-মন্দ দুটো উদাহরণই ছিল এবং আমি ভালোটিই বেছে নিয়েছি।  

প্রশ্ন: নিজে যখন তরুণদের জন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন, তখন কেমন লেগেছে?

মার্সেলো: আমি সবকিছু সবসময়ই সহজভাবে গ্রহণ করি। মিলিতাও, ফেদরিকো ভালভারদে, কামাভিঙ্গা, ভিনিসিউস জুনিয়র, রদ্রিগো, অ্যাসেনসিও, কারভাহাল, নাচোসহ যারা পরে এসেছেন, সবার সাথে সহজ সম্পর্ক ছিল। ওদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকতাম। 

আমি হয়তো টানা ১০ মিনিট কারও সাথে কথা বলার মতো নই। কিন্তু যখন কারও সাহায্য প্রয়োজন, আমাকে সবসময় পাওয়া যায়। কেউ হয়তো বাজে ম্যাচ খেলে দর্শকদের দুয়ো পেল কিংবা গোল মিস করল অথবা আত্মঘাতী গোল দিল – তখনই অধিনায়কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ২৩ বছর বয়সেই আমি ক্লাবের একজন অধিনায়ক হই। এসব তাই আমাকে দ্রুত শিখতে হয়েছে।  

প্রশ্ন: তরুণ কোন খেলোয়াড়ের কঠিন মুহূর্তে আপনার পাশে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে, এমন উদাহরণ আছে?

মার্সেলো: বেশ কয়েকটি। কিন্তু সেটি এখানে বলব না (হাসি)।

আমার মনে হচ্ছিল নিজের কাজটুকু শেষ করে আমি মাদ্রিদ ছাড়ছিপ্রশ্ন: রিয়াল মাদ্রিদে আপনার সেরা সময় বলে কোন মুহূর্তকে মনে করেন?

মার্সেলো: একটি ছিল রিয়াল মাদ্রিদ থেকে বিদায়ের দিন। সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ছিল যখন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সমর্থকরা গাইছিল, ‘মার্সেলো, থেকে যাও’। এটি অনেক মজার ছিল। যদিও সবাই জানত যে আমি আর থাকছি না। রসিকতা করেই এমনটি বলছিল। আমারও ভালো লাগছিল।

সেদিন আমার মনে হচ্ছিল, নিজের কাজটুকু শেষ করে আমি মাদ্রিদ ছাড়ছি। এখানে আসার পর প্রথম সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, দলকে শিরোপা জেতাতে সাহায্য করতে চাই। রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার সময় আমি ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি শিরোপা জেতা ফুটবলার। আমার রেকর্ড কেউ একদিন পেছনে ফেলে দেবে। সেদিন আমি খুশি হব, কারণ মাদ্রিদ তো জিততেই থাকবে। তবুও আমার জন্য এমন অর্জন নিয়ে শেষ করা অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার।

জানি না, অন্য কোন ক্লাব কখনো আমাকে নিতে আগ্রহী ছিল কিনা। তেমনটা হলেও আমি রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়তাম না। কারণ আমি সবসময় এখানেই থাকতে চেয়েছি। 

এখনও যখন রিয়াল মাদ্রিদে ফিরে আসি, অফিসিয়াল, খেলোয়াড়, রেস্টুরেন্ট স্টাফ, নিরাপত্তা কর্মী, চিকিৎসক সবার ভালোবাসা পাই। তখন মনে হয়, আমি হয়তো স্কুল পরিবর্তন করেছি, পুরনো বন্ধুদের রেখে গেছি এবং এখানে ফিরলে আবারও সবার সাথে দেখা হচ্ছে। 

প্রশ্ন: মাদ্রিদে মার্সেলোর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যে একজন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। যে জুটিকে প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়…

মার্সেলো: ক্রিস এবং আমার অনেক ভিডিও আছে। ট্রেনিংয়ে আমাদের মজা করা, ‘সিউউউউ’ উদযাপন নিয়ে এমন অনেক কিছু। পাশাপাশি রামোস, কাসেমিরো, লুকা (মদরিচ), করিম (বেনজেমা) – আমার আরও অনেক বন্ধু আছে। এটা খুব স্বাভাবিক যে, ক্রিশ্চিয়ানোর সঙ্গে ভিডিওগুলোর প্রচার বেশি হয়েছে। তবে ফুটবলের অন্য অনেক বন্ধুর সঙ্গেও ফুটবলের বাইরে অনেক মজা করেছি আমি। 

প্রশ্ন: রোনালদো থেকে এখন আমরা অন্য এক প্রসঙ্গে আসি। লিওনেল মেসির মুখোমুখি হওয়ার প্রসঙ্গে…

মার্সেলো: মেসি অবিশ্বাস্য এবং এখন পর্যন্ত আমার মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ। এই ৩৫ বছর বয়সেও তিনি কেমন ফুটবলার, সেটি সবাই জানি। সবসময় তিনি অসাধারণ। দেখা এবং খেলার জন্যও ‘এল ক্লাসিকো’ অন্যতম সেরা। আমি খুব ভাগ্যবান যে ‘এল ক্লাসিকো’র অন্যতম সেরা সময়ে খেলতে পেরেছি। তবে সেখানে শুধু মেসিই নন, অন্যান্য অনেক অনবদ্য ফুটবলাররাও ছিলেন। 

প্রশ্ন: ক্যারিয়ারের এ পর্যায়ে এসে ব্রাজিলের ক্লাব ফ্লুমিনেন্সে ফেরার সিদ্ধান্ত কেন? 

যে ক্লাবে খেলে বেড়ে উঠেছি, রিয়াল মাদ্রিদ ও ব্রাজিলের ক্যারিয়ারের জন্য যে ক্লাব আমাকে তৈরী করেছে, সেখানে ফিরতে পারাটাই সবচেয়ে আনন্দের। 

এই আবেগটা অবিশ্বাস্য। রিও দি জানেইরোতে শুধু নয়, নিজের ঘর ফ্লুমিনেন্সে ফিরতে পেরেছি। আবারও এই ক্লাবের জার্সি গায়ে চড়ানোর সম্ভাবনা আমাকে রোমাঞ্চিত করছে। কোপা লিবের্তাদোরেস খেলতে চাই, যে টুর্নামেন্টে আগে কখনও খেলিনি। ফ্লুমিনেন্সকে লিবের্তাদোরেস জেতাতে সাহায্য করতে চাই আমি।

প্রশ্ন: এখানেই কি অবসর?

মার্সেলো: সামনে কি ঘটবে, জানি না। তবে আরও কিছু বছর খেলা চালিয়ে যেতে চাই। কিন্তু যদি ফুটবল খেলা থামাতেই হয়, হোক সেটি ফ্লুমিনেন্সেই। ছোটবেলা থেকে তাঁরা যেভাবে আমাকে সাহায্য করেছে, ভালবেসেছে; সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই আমার এমন ইচ্ছা। 

প্রশ্ন: আবারও মাদ্রিদে ফেরার ইচ্ছা আছে কি?

মার্সেলো: ফুটবল শেষে কী করব, সেটি স্পষ্ট জানি আমি। অনেক কিছু করার আছে তখন; মাঠে দেয়ার মত সময় আমার হাতে হয়ত থাকবে না। 

হয়তো রিয়াল মাদ্রিদের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারি। কিন্তু কী করব, সে ভাবনায় তাড়াহুড়ো নেই কোনো। কেননা রিয়াল মাদ্রিদ আমার নিজ বাড়ির মতো। আমি সবসময় মাদ্রিদের সাথে আছি এবং মাদ্রিদও আমার সাথে আছে।  

ইন্টারভিউয়ের ঠিক এই সময় স্কুল থেকে এসে যোগ দেন মার্সেলোর ছেলে এনজো। রিয়াল মাদ্রিদের একাডেমী ‘লা ফ্যাব্রিকা’য় তিনি যোগ দেন ২০১৭ সালে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে করেন প্রথম পেশাদার চুক্তি। বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভীষণ ঘনিষ্ট। 

ফুটবলীয় পরিবেশে বড় হয়েছেন এনজো। সেটি প্রমাণ হয় ২০১৩ সালের কনফেডারেশনস কাপ নিয়ে নিজের প্রথম ফুটবল স্মৃতির কথা যখন বলেন তিনি। যেখানে মারাকানায় তাঁর বাবার দল ব্রাজিল ৩-০ গোলে স্পেনকে হারিয়েছিল। 

বাবা মার্সেলোর সাথে ছেলে এনজোএনজো: আমি তখন মাঠে গিয়েছিলাম। বাবার সঙ্গে, ট্রফির সঙ্গে এবং নেইমারের সঙ্গে ছবি তুলেছিলাম। ব্রাজিলের ফুটবলারের সঙ্গেও খেলছিলাম। মনে আছে, দাভিদ লুইজের সঙ্গে খেলছিলাম আমি।  

প্রশ্ন: মার্সেলোর ছেলে পরিচয় কতটা উপভোগ করেন?

এনজো: বাসায় একদম স্বাভাবিক; সবাই আমাকে ভালোবাসে। সতীর্থদের সঙ্গে ড্রেসিংরুমেও বিষয়টা একই। সবাই আমাকে স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করে। আমি বুঝি যে, আয়েশী না হয়ে আমাকে প্রতিনিয়ত কঠোর অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে।

প্রশ্ন: আপনার সারাদিনের রুটিন কী?

এনজো: সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাই এবং সেখান থেকে ফিরে সরাসরি অনুশীলনে। ফুটবলের পাশাপাশি আমি পড়াশোনা চালিয়ে যাই। অবসর সময়ে পড়ি, যেন এ জায়গাাটায় পিছিয়ে না যাই। মাঝেমধ্যে ট্রেনিং সেন্টারের বাইরে বাবার সঙ্গে অনুশীলন করি। তিনিও আমাকে সাহায্য করেন। 

প্রশ্ন: এমন কোন তিনটি স্বপ্ন যেগুলো পূরণ করতে চান? 

এনজো: এক নম্বরে সবচেয়ে বেশি করে চাই, রিয়াল মাদ্রিদ মূল দলে খেলতে। দ্বিতীয় স্বপ্ন বিশ্বকাপ জেতা। আর তৃতীয়টি বাবাকে সবসময় ফিফা গেমে হারানোটা ধরে রাখা। 

প্রশ্ন: এনজোর রোল মডেল?

এনজো: ছোটবেলা থেকে করিম বেনজেমার খেলা আমার অনেক পছন্দ। আমি সবসময় তাঁকে দেখি এবং তাঁর খেলার ধরণ আমাকে মুগ্ধ করে। এছাড়াও আমি রোনালদো নাজারিওকে অনুসরণ করি, গোলকিপারকে কাটিয়ে তাঁর গোল করাটা অসাধারণ।

বাবার বাইরে এ দুজনের কথা বললাম। আর বাবাকে নিয়ে তো গর্ব হয়ই। সবচেয়ে বেশি গর্ব হয়, যখন দেখি সবাই তাঁকে একইভাবে সম্মান করেন। তিনি অনেক নম্র, সবার সাথে একইরকম ব্যবহার করেন।

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Add