পানি-পুরি বিক্রেতা থেকে আইপিএলের সেঞ্চুরিয়ান

৩ মে ২০২৩

পানি-পুরি বিক্রেতা থেকে আইপিএলের সেঞ্চুরিয়ান

দিনে ক্রিকেটার, রাতে পানি-পুরি বিক্রেতা। নাটক, সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজের স্ক্রিপ্ট মনে হতে পারে। না, এটি জীবনের গল্প। আইপিএলের হাজারতম ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান যশস্বী জয়সওয়ালের রূপকথার গল্প।

রাজস্থান রয়্যালসের ওপেনার সেদিন খেলেছেন ৬২ বলে ১২৪ রানের ইনিংস। যা সাজানো ১৬ চার এবং ৮ ছক্কায়। অর্থাৎ, ১২৪ রানের মধ্যে ১১২ রানই এসেছে বাউন্ডারীর সীমানা পেরোনা শটে। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বিপক্ষে জয়সওয়ালের দল জেতেনি তবুও। তবে রেকর্ড হয়েছে বেশ কিছু। এবারের আইপিএলের তৃতীয় সেঞ্চুরির ইনিংসটি এখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। রাজস্থান রয়্যালসের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ইনিংসেও জশ বাটলারের সঙ্গী এখন তিনি। 

রাজস্থান রয়্যালসের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ইনিংসেও জশ বাটলারের সঙ্গী এখন জয়সওয়ালএছাড়াও ভারত জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয়নি, এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে আইপিএলের সর্বোচ্চ ইনিংস এটি। এক যুগ টিকে থাকা পল ভ্যালথাটির ১২০ রান পেরিয়ে গেছে যা। 

তবে ব্যাটের উজ্জ্বলতায় রেকর্ডের খাতা রঙিন হলেও ম্যাচ হারের কষ্ট নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে জয়সওয়ালকে। তাঁর জীবনের শুরুর দিকের গল্পটিও ছিল এমনই কষ্টের। 

উত্তর প্রদেশের ভাদোহীতে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম। বাবা ভুপেন্দ্র জয়সওয়াল ছিলেন ছোট্ট হার্ডওয়্যার দোকানের মালিক। ছয় সন্তানের মধ্যে জয়সওয়াল চতুর্থ। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আলাদা ভালোবাসা ছেলেটির।

মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবার সাথে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান। ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য। বাবা পরবর্তীতে নিজ গ্রামে ফিরে গেলেও জয়সওয়াল থেকে যান ওই বড় শহরে। স্বপ্ন পূরণের তাগিদে। 

ব্যাটের উজ্জ্বলতায় রেকর্ডের খাতা রঙিন হলেও ম্যাচ হারের কষ্ট নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে জয়সওয়ালকেপ্রথমে চাচার বাসায় থাকার ব্যবস্থা। কিন্তু বাবা গ্রামে ফেরার পর সেটি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ওই অনিশ্চিত জীবনে জয়সওয়ালের একমাত্র অবলম্বন ক্রিকেট। আজাদ ময়দানে ব্যাট-বলের শব্দে খুঁজে ফেরেন জীবনের অর্থ। 

২০১৩ সাল। আজাদ ময়দানে একটা ম্যাচ চলছিল। স্থানীয় এক কোচ জয়সওয়ালকে ডেকে বলেন, এই ম্যাচে ভালো খেললে এখানেই তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দিবেন। চ্যালেঞ্জে জেতেন। পুরস্কার হিসেবে আজাদ ময়দানে পিচ কিউরেটরদের সঙ্গে অস্থায়ী তাঁবুতে থাকার জায়গা হয় জয়সওয়ালের।

মাঠই তাই হয়ে যায় জয়সওয়ালের বাড়ি-ঘর।

পরিবারের সঙ্গে জয়সওয়ালমাথা গোঁজার ব্যবস্থা তো হল। কিন্তু খাবেন কী? খেতে তো পয়সা লাগে। অদম্য জয়সওয়াল যেটি যোগাড়েও নেমে যান মাঠে। দিনে আজাদ ময়দানে ক্রিকেট খেলেন। সন্ধ্যায় ময়দানের সামনে বেচেন পানি-পুরি। সামান্য যা আয়, তাতেই আধপেটা-একপেটা খেয়ে ক্রিকেটের স্বপ্নে লেপ্টে থাকেন ১১ বছরের ছোট্ট জয়সওয়াল। 

বছর দুই বাদে এই ক্রিকেটের সৌজন্যেই কিছুটা স্বস্তি। মুম্বাইয়ের আরেক স্থানীয় কোচ জয়ালা সিং তাঁর মধ্যে দেখেন প্রতিভা। নিজ বাড়িতেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এই কোচের প্রতি আজীবনের ঋণ তাই জয়সওয়ালের। 

 সন্ধ্যায় ময়দানের সামনে বেচেন পানি-পুরিবয়স বাড়ে। দূরের স্বপ্ন একটু একটু করে কাছে আসে। ২০১৯ সালে বিজয় হাজারে ট্রফিতে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে অভিষেক জয়সওয়ালের। তাঁর স্বপ্নের দল মুম্বাইয়ের হয়েই। কেননা তাঁর ক্রিকেটীয় আইডল শচীন টেন্ডুলকারের দল যে এটি! 

অভিষেক ম্যাচটা রাঙিয়ে না রাখতে পারলেও সেই মৌসুমে গড়েছেন দারুণ সব রেকর্ড। ঝাড়খন্ডের বিপক্ষে ১৫৪ বলে করেন ২০৩ রান। ১৭ বছর বয়সী জয়সওয়াল লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে পান ডাবল সেঞ্চুরির দেখা। মৌসুমে মাত্র পাঁচ ম্যাচে তাঁর পাঁচ শতাধিক রান। যার মধ্যে ডাবল সেঞ্চুরি ছাড়াও আছে দুটি সেঞ্চুরি।

স্থানীয় কোচ জয়ালা সিংয়ের সঙ্গে জয়সওয়াললিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে দুর্দান্ত এই ব্যাটিংয়ের কারণে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে ডাক পড়ে। ২০২০ সালেও ওই টুর্নামেন্টের অন্যতম সফল খেলোয়াড় জয়সওয়াল। ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। তবে জয়সওয়ালের পারফরম্যান্স চোখ ধাঁধানো। সর্বোচ্চ ৪০০ রান করে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জেতেন।

একই বছরে জয়সওয়াল ডাক পান আইপিএলে। দুই কোটি চল্লিশ লাখ রুপিতে তাঁকে দলে ভেড়ায় রাজস্থান রয়্যালস। সেবারের আসরে তেমন সুযোগ না পেলেও তাঁকে রিটেইন তালিকা রাখে দলটি। পরবর্তী আসর থেকে দলের নিয়মিত মুখে পরিণত হন। এবারের আইপিএলে তো পার করছেন সেরা সময়।

২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন জয়সওয়ালএবার এখন পর্যন্ত আইপিএলের ৯ ম্যাচে ৪৭.৫৫ গড়ে করেছেন ৪২৮ রান। স্ট্রাইক রেট প্রায় ১৬০। এক সেঞ্চুরি সঙ্গে তিন হাফ সেঞ্চুরি। অরেঞ্জ ক্যাপের দৌড়েও জয়সওয়াল আছেন দারুণভাবে। 

আর জীবনের দৌড়ে এরই মধ্যে বিজয়ী তিনি। পানি-পুরি বিক্রি করা ছেলেটি যে আইপিএলের সেঞ্চুরিয়ান! স্বপ্ন-দৌড়ের আরেক ল্যাপে এই জয়সওয়ালের গায়ে একদিন ভারতের জার্সিও উঠবে – সে বাজি ধরতে পারেন নির্দ্বিধায়।

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Add