মরণকে জয় করে আসা রোনালদো

৩১ অক্টোবর ২০২২

মরণকে জয় করে আসা রোনালদো

ফুটবল ইতিহাসে প্রথম বিলিনিয়ার ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ক্যারিয়ারে তাঁর উপার্জন বাংলাদেশী মুদ্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিশাল গাড়ি সংগ্রহে সবচেয়ে দামি গাড়িটির দাম ৮৭ কোটি টাকা। কে বলবে, এখন এমন অর্থের সমুদ্রে ডুবে থাকা রোনালদোর প্রথম জীবনটা ছিল দারিদ্রের সঙ্গে অমন লড়াইয়ের। পরিবারে অভাব এতই প্রকট ছিল যে, গর্ভে থাকা অবস্থায় রোনালদোর মা রোনালদোকে মেরেই ফেলতে চেয়েছিলেন!

রোনালদোর বাবা দিনিস আভেইরো ও মা দোলোরেস আভেইরো। তাঁদের অভাবের সংসারে ততদিনে তিন সন্তান এসে গেছে। দিনিস শহরের মিউনিসিপালে মালির কাজ করতেন সংসার চালানোর জন্য। তাতেও টানাটানি না যাওয়ায় দোলোরেস শুরু করেন রাঁধুনির কাজ। ওদিকে আরেক সমস্যা, পরিবারের কর্তা দিনিসের মদে আসক্তি। সংসারে অভাব, স্বামী মদ্যপ -- আরেকবার গর্ভবতী হলে দোলোরেস তাই ভ্রুণ নষ্ট করে ফেলার কথা ভাবেন বাস্তবতা মাথায় রেখে। আর এই বিস্ফোরক নিজেই দিয়েছেন রোনালদোর মা।

২০১৪ সালে ‘মাদার কারেজ’ নামে আত্মজীবনীতে এ ঘটনা উল্লেখ করেন দোলোরেস। তিনি রোনালদোকে গর্ভে মেরে ফেলতে চাইলেও ডাক্তার রাজি হন না। মরিয়া হয়ে নিজেও সে চেষ্টা করেন। কিভাবে, জানেন? গরম বিয়ার খেয়ে! গর্ভপাতের জন্য এত্ত এত্ত গরম বিয়ার খান দোলোরেস। কিন্তু তাতেও তো রোনালদোর পৃথিবীতে আসা আটকানো যায়নি। ‘আমি গর্ভপাত চেয়েছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর তা হতে দিতে চাননি’ -- বলেছেন রোনালদোর মা।

পৃথিবীর আলোয় এল তাই পরিবারের চতুর্থ সন্তান। বাবা তাঁর এই ছেলের নাম রাখলেন রোনালদো; প্রিয় অভিনেতা এবং যিনি ওই সময় আবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, সেই রোনাল্ড রেগানের সঙ্গে নাম মিলিয়ে। রোনালদো বড় হয়ে উঠতে লাগলেন অভাবের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে। চার ভাই-বোন গাদাগাদি করে থাকতেন একই ঘরে। বাবা-মাকে সাহায্য করার জন্য রেস্তোরায় কাজ করেছেন। কোনো বেলায় খাওয়া জুটত, কোনো বেলায় জুটত না। ম্যাকডোনাল্ডসের সামনে রোনালদো ঘুরঘুর করতেন যদি কেউ দয়া করে কিছু খেতে দেয়।

পেটে ক্ষুধা থাকলেও রোনালদোর মনে আনন্দের অভাব ছিল না। কারণ ফুটবল। সেই ছোট্টটি থেকেই ফুটবলের প্রেমে পড়ে যান পুরোপুরি। বাবা মদ্যপ হলেও ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা প্রচন্ড। আর ততদিনে অপেশাদার ক্লাব ‘আন্দোরিনহা’র কিটম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। ৮ বছর বয়সে এখানে ফুটবলার হিসেবে যোগ দেন রোনালদো। ছেলের ফুটবলে বাবার সে কী উৎসাহ! ২০০৫ সালে অতিরিক্ত মদ্যপানে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই বাবাই ছিলেন রোনালদোর ফুটবলে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় উৎসাহদাতা।

৮ বছরে আন্দোরিনহো, ১০ বছরে নাসিওনাল, ১২ বছর বয়সে পতুর্গালের অন্যতম বড় ক্লাব স্পোর্তিং লিসবনে যোগ দেন রোনালদো। আর ১৪ বছর বয়সে ঠিক করলেন, পড়ালেখা আর করবেন না। মাকে বোঝালেন, তাঁর জীবন আঁকা ফুটবলেই। স্পোর্তিং লিসবসে খেলার জন্য মাদেইরায় পরিবারকে ছেড়ে লিসবন শহরে আসতে হয় রোনালদোকে। এর পেছনে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা যেমন ছিল, ঠিক তেমনই পরিবারকে দারিদ্রের থাবা থেকে মুক্তি দেওয়ার তাড়নাও।

এগুচ্ছিল সব ঠিকঠাক। কোচরা তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ। বল বলে জাদু দেখান নিয়মিত। হঠাৎ বেজে ওঠে সর্বনাশের ঘন্টা। বয়স যখন ১৫, হৃদপিন্ডের এক জটিল সমস্যা ধরা পড়ে রোনালদোর। ফুটবল ছেড়ে দেবার দশা হয়। শেষ পর্যন্ত একটা অপারেশনে অবশ্য আবার মাঠে নামার ছাড়পত্র পান রোনালদো।

এরপর আরো দ্রুত গতিতে রোনালদোর ছুটে চলা। প্রতিভা দিয়ে। পরিশ্রম দিয়ে। হার না মানা মাসনিকতা দিয়ে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে অভিষেক হয় স্পোর্তিং লিসবনের মূল দলে; ২০০২ সালে। পরের বছর আরো বড় ব্রেক। মৌসুম শুরুর আগে স্পোর্তিং লিসবনের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে পর্তুগাল যায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ম্যাচে এমনই চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স রোনালদোর যে, ইংল্যান্ডে ফেরার ফিরতি ফ্লাইটে ইউনাইটেডের খেলোয়াড়রা গিয়ে কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের কাছে আবদার করেন, তাঁকে দলে নেবার জন্য। ২০০৩ সালে ১২ মিলিয়ন পাউন্ড ট্রান্সফার ফিতে রোনালদোকে কিনে নেয় ম্যানইউ। বেস্ট-রবসন-ক্যান্টোনা-বেকহামদের ‘৭’ নম্বর জার্সি খুঁজে পায় নতুন উত্তরাধিকার।

এরপর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে স্বর্ণালী সাফল্যের ছয় মৌসুম, রিয়াল মাদ্রিদের ৯ মৌসুমে সেটিকেও ছাড়িয়ে যাওয়া, ৫ বার বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জেতা, ক্লাবের হয়ে সম্ভাব্য সব ট্রফি জয়, জাতীয় দল পর্তুগালের জার্সিতে ইউরো ও উয়েফা নেশসনস লিগ জয় - এক বিশ্বকাপ বাদে কী জেতেননি রোনালদো! শুধু শুধুই তো তিনি ঘোষণা দেন না এই বলে যে, ‘ আমি জন্মেছি সেরাদের সেরা হওয়ার জন্য।’

কিন্তু সেই জন্মটাই তো রোনালদোকে দিতে চাননি তাঁর মা! দারিদ্র্যের দুশ্চিন্তায়। এখন রোনালদোর নিজেরও চার সন্তান। অর্থ-বিত্ত-প্রাচুর্যের মধ্যে থাকা ওই সন্তানদের কী নিজের জীবনের এই গল্পটি বলেছেন? দাদী দোলোরেসকে কি সেটি বলে খ্যাপায় এখন রোনালদোর সন্তানরা? কী অপার্থিক আনন্দের এক পারিবারিক ছবিই না তখন তৈরী হয়! মায়ায়। ভালোবাসায়।

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Add