সানিয়া মির্জা: সংগ্রাম ও সাফল্যের দীর্ঘ পথচলা

৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সানিয়া মির্জা: সংগ্রাম ও সাফল্যের দীর্ঘ পথচলা

টেনিস খেলে তোমার গায়ের রঙ কালো হয়ে যাবে, তখন আর কেউ তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে না। মাত্র আট বছর বয়সে যে মেয়েকে শুনতে হয়েছে বৈষম্যের এমন কথা, সে মেয়েটিই পরিণত বয়সে অর্জন করেছেন বিশ্ব টেনিসের এক নম্বর স্থান। জিতেছেন ছয় ছয়টি গ্র‍্যান্ড স্ল্যাম সহ অসংখ্য শিরোপা। তিনি সানিয়া মির্জা। 

সানিয়ার বাবা-মার লড়াইটাও কী কম! রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়েকে টেনিসের মত আউটডোর স্পোর্টস এর সুযোগ করে দেয়ায় সইতে হয়েছে অনেক সমালোচনা। এমনকি বাবা ইমরান মির্জা তো নিজের সাংবাদিকতা ক্যারিয়ার অনেকটা বিসর্জন দিয়ে লেগে থেকেছেন মেয়ের টেনিস সংগ্রামের সাথে। 

বাবা ইমরান মির্জা’র সাথে সানিয়া মির্জা

ভারতীয় উপমহাদেশের খেলাপাগল মানুষের হৃদয়জুড়ে আছে ক্রিকেট। এবং ফুটবল। সে অঞ্চলের একজন নারী হয়ে বিশ্ব টেনিসে আধিপত্য করা এক অনুপ্রেরণার নাম সানিয়া মির্জা। মাত্র ৬ বছর বয়সে টেনিস খেলতে শুরু করা সানিয়ার এ দীর্ঘ যাত্রায় পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। আর এ যাত্রায় সবচেয়ে বেশি সমর্থন যুগিয়েছে তাঁর পরিবার। সানিয়া তাই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেন যে, তাঁর মা-বাবা যথেষ্ট প্রগতিশীল ছিলেন।

২০০৫ সালের সানিয়া বিশ্ব টেনিসের মঞ্চে আলোড়ন তৈরি শুরু করছেন কেবল। তখনই তিনি এক দল কট্টর মুসলিম পন্ডিতের সমালোচনার শিকার হন। সানিয়ার স্কার্ট এবং টি শার্ট পরে টেনিস খেলা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। দাবি করেন, এমন কাপড় পরে খেলা মুসলমান তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভাষায় "কল্পনারও বাইরে" থাকা এসব পোশাক পড়ায় সানিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা হয় ফতোয়া।

 শোয়েব মালিক ও সানিয়া মির্জা

শুধু কট্টর মুসলিমদের থেকেই নয়; পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে বিয়ে করায় কট্টর হিন্দু এবং বিজেপি নেতাদের রোষানলেও পড়েন তিনি। বিজেপি নেতা কলরাজ মিশ্র তো মালিককে বিয়ে করার ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ভাবতে পর্যন্ত বলেন সানিয়াকে। বিয়ের পর প্রশ্ন করা হয়, ভারতের প্রতি সানিয়ার আনুগত্য নিয়ে। এমনকি সর্বভারতীয় টেনিস ফেডারেশন নিশ্চিত করে নেয় যে, সানিয়া ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে দায়বদ্ধ কিনা।

২০১৪ সালের আরেক ঘটনা। তেলেঙ্গানা রাজ্য সরকার সানিয়াকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর নিয়োগ করে। বিজেপি নেতারা তখন তাকে পাকিস্তানের পুত্রবধূ হিসেবে সমালোচনা করে সানিয়ার আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এছাড়াও নিজ দেশের ক্রীড়া সমালোচকরাও তাঁর সমালোচনা করেন একক ক্যাটাগরিতে ক্যারিয়ার দীর্ঘ না হওয়ায়। অথচ সানিয়াই প্রথম ভারতীয় নারী হিসেবে বিশ্ব টেনিসের একক র‍্যাঙ্কিংয়ে সেরা ৩০-এ ঢোকেন। উঠেন ২৭ তম পর্যন্ত। আর ভারতীয় টেনিসের এক নম্বরে তারকাও তো ছিলেন তিনি।

দীর্ঘ প্রায় দুই দশকের পেশাদার খেলোয়াড় জীবনে সানিয়া যখনই সাফল্য আর অর্জনের দিকে এগিয়েছেন, তখনই তাকে সইতে হয়েছে তীব্র সমালোচনার বাধা। অথচ প্রাচীন প্রথা আর রীতিনীতির বাইরে বেরিয়ে, মানিয়ে চলা আর আত্মত্যাগের ধরাবাধা নারীজীবন পাশে ফেলে তিনি ভারতীয় নারীদের পথ দেখিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া থেকে স্বীকৃতি আদায়ের বাস্তবতায়।

সানিয়া মির্জা তাঁর অর্জন আর শিরোপায় বিশ্ব টেনিসের মানচিত্রে ভারতের শক্ত অবস্থান করে দিয়েছেন। ভেঙেছেন উপমহাদেশের নারীদের পায়ে বটের শিকড় হয়ে জড়িয়ে যাওয়া পুরুষতান্ত্রিকতার শিকল। অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছেন অসংখ্য নারী খেলোয়াড়ের।

ইউএস ওপেন চ্যাম্পিয়ন সানিয়া মির্জা-মার্টিনা হিঙ্গিস জুটি, ২০১৫

দুই দশকের ক্যারিয়ারে সানিয়া জিতেছেন ছয়টি গ্র‍্যান্ড স্ল্যাম। জুটি গড়েছেন মার্টিনা হিঙ্গিস এবং ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কার মত বিশ্বখ্যাত তারকার সাথে। রেকর্ড ৯১ সপ্তাহ তিনি ছিলেন টেনিসে নারীদের দ্বৈত র‍্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর স্থানে। এছাড়াও এসএ গেমস, কমনওয়েলথ গেমস সহ বিভিন্ন খেলায় ভারতের হয়ে তিনি জিতেছেন অসংখ্য শিরোপা।

২০২৩ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে সানিয়া ঘোষণা দেন পেশাদার টেনিস থেকে অবসর নেয়ার। ফেব্রুয়ারির দুবাই টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে শেষবারের মত খেলতে দেখা যাবে তাকে। আরও কিছু দিন হয়েতো খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন। ৪ বছর বয়সী ছেলে ইজহান মালিকের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এখনই বিদায় বলছেন।

তবে সানিয়া মির্জা তাঁর ক্যারিয়ার ও জীবনজুড়ে প্রত্যয়, সংগ্রাম আর অর্জনের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা অনগ্রসর নারীসহ সবাইকে যুগ যুগ ধরে যোগাবে অনুপ্রেরণা। 

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Add