ফুটবলে অর্থ ছড়িয়ে যাবে সৌদি লিগ
৫ আগস্ট ২০২৩

অর্থের ঝলকানিতে অনেক আগে থেকেই পরিচিত আরব শেখরা। বিলাসবহুল জীবনযাপনেও এগিয়ে তারা। তবে হঠাৎ করেই নতুন আগ্রহ পেয়ে বসেছে তাদের! খেলার প্রতি, বিশেষভাবে ফুটবলের প্রতি। তাইতো গেলোবছর যে লিগ, লিগের ক্লাবগুলো বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের অজানা ছিল সেই লিগই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
আর্থিকভাবে লোভনীয় প্রস্তাবের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই অনেক তারকা ফুটবলারকে সৌদিতে এনেছে ক্লাবগুলো। অর্থের এই বিশাল বিনিয়োগ শুধু আগ্রহের জন্যেই নয় বরং ফুটবল নিয়ে তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের যাত্রা। ফুটবলের আরেকটি শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান বিশ্বে তুলে ধরা। তাইতো ইউরোপের তারকা খেলোয়াড় কিনতে অর্থের কার্পণ্যতা দেখায়নি তারা।
আর খেলোয়াড় কেনায় সৌদি প্রো লিগের (এসপিএল) ক্লাবগুলোর এমন ‘অভাবনীয়’ অর্থ খরচ করা চলতেই থাকবে বলে জানিয়েছেন লিগের শীর্ষ স্থানীয় এক কর্মকর্তা।
লিগের নির্বাহী পর্ষদের এই ব্রিটিশ পরিচালক পিটার হাটন জানান, কয়েক বছরের জন্য বাজেট বরাদ্দ আছে। ফুটবলার কেনাতে তাদের এই খরচ থামার কোনো সম্ভাবনা নেই।
সৌদি প্রো লিগ ইতিমধ্যেই ফুটবল অঙ্গনের বড় বড় তারকাদের আকৃষ্ট করতে পেরেছে। শুরুটা হয়েছিল পাঁচ বারের ব্যালন ডি অর জয়ী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মাধ্যমে। এই বছরের জানুয়ারিতে পর্তুগিজ ফরোয়ার্ডকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে কিনে নেয় সৌদি ক্লাব আল-নাসের।
এরপর একে একে ইউরোপীয় বড় ক্লাবগুলোর বিভিন্ন তারকাকে নিজেদের দিকে টানতে থাকে এসপিএল। যাদের মধ্যে রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ স্ট্রাইকার করিম বেনজেমা, লিভারপুল অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন, বায়ার্ন মিউনিখ তারকা সাদিও মানে।
শুধু তাই নয়, গত মাসে সৌদি ক্লাব আল-হিলাল ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পেকে নেওয়ার জন্য তার ক্লাব প্যারিস সেন্ট-জার্মেইনকে রেকর্ড ৩০ কোটি ইউরোর প্রস্তাব দেয়!
এর আগে ইউরোস্পোর্ট, ইএসপিএন, আইএমজি ও ফেইসবুকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হাটন বলেন, “আমি স্পোর্টসে কাজ করেছি ৪০ বছর কিন্তু এত বড়, এত উচ্চাভিলাষী এবং সাফল্যের জন্য এত বদ্ধপরিকর কোনো প্রকল্প দেখিনি।”
বিবিসির রেডিও ফাইভের বিশেষ অনুষ্ঠান “দি সৌদি স্টোরি” তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হাটন বলেন, “এটি নিয়ে পুরো বিশ্বের ক্রীড়াঙ্গন কথা বলছে কিন্তু তারা যে পরিমাণ খরচ করছে তা এই গ্রীষ্মে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর মোট খরচের এক-চতুর্থাংশ কিংবা এক-পঞ্চমাংশ মাত্র।”
ম্যানচেস্টার সিটির কোচ পেপ গার্দিওলার মতে, সৌদি প্রো লিগের অর্থনৈতিক দাপট ইতিমধ্যেই দলবদলের বাজার পরিবর্তন করে দিয়েছে এবং এ নিয়ে বড় ক্লাবগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। অন্যদিকে লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপও ইউরোপীয় লিগের অনেক পরে সৌদি লিগের খেলোয়াড় কেনার সুযোগ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন।
জার্মানি-ভিত্তিক ওয়েবসাইট ট্রান্সফারমার্কটের মতে, গ্রীষ্ম মৌসুমে এসপিএলের ক্লাবগুলো ৪০ কোটি ৯ লাখ ইউরো ব্যয় করছে, যা ফুটবল বিশ্বে পঞ্চম সর্বোচ্চ। এটি স্পেনের লা লিগার মোট ব্যয় ২০ কোটি ৫৪ লাখ মিলিয়ন ইউরোর চেয়েও বেশি। ১৩৭ কোটি ইউরো খরচ করে ব্যয়ের দিক দিয়ে প্রিমিয়ার লিগ শীর্ষে রয়েছে।
ফুটবল পরাশক্তিদের কাছে এসপিএল কী রকম ভীতির কারণ হতে পারে জানতে চাওয়া হলে হাটন বলেন, “ফুটবলে সৌদিদের বিনিয়োগের পরিমাণ অভাবনীয়। তার মানে এই নয় যে ইউরোপ ফুটবল বিশ্বে তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে না। কিন্তু আমি একথা বলব যে এটি কোনোভাবেই একটি খারাপ দিক নয়। এটা আরও ভালো যে পৃথিবীর অন্য প্রান্তেও ফুটবলের শক্তি রয়েছে।”
দুর্নাম ঘুচাতে খেলাধুলায় বিনিয়োগ?
বর্তমান বছরগুলোতে সৌদি আরব খেলাধুলায় অনেক বিনিয়োগ করেছে। অনেকেই এই ধরনের বিনিয়োগকে দেশটির বিভিন্ন মানবাধিকার ও নারী অধিকার নিয়ে যে দুর্নাম রয়েছে, তা ঢাকতে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে। যাকে ‘স্পোর্টসওয়াশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
এ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে হাটন জানান, “মাঠের মধ্যে কি হচ্ছে তা দেখে আমি সৌদি আরবের এই প্রকল্পে সম্পৃক্ত হয়েছি। আমার স্ত্রী ফিফার সাথে নারী ফুটবল নিয়ে কাজ করে। সে আরবের এ সব বিষয় জানে। দেশটির পরিস্থিতির এখন পরিবর্তন হচ্ছে। সমাজে এই খেলোয়াড়রা কী পরিমাণ খুশির উপলক্ষ্য এনে দিচ্ছে আপনি এখন দেখতে পারবেন।”
ক্লাবগুলোর আছে সমর্থকগোষ্ঠী
এসপিএলের এই উত্থানকে অনেকেই বড় অংকের অর্থ খরচ করা চাইনিজ সুপার লিগের সাথে তুলনা করছে, যা জাঁকজমকভাবে শুরু হওয়ার পর নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে।
সৌদি আরবের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) ইতিমধ্যেই এসপিএলের শীর্ষস্থানীয় চারটি ক্লাবের মালিকানা নিয়েছে।
হাটন বিশ্বাস করে এসপিএলে সৌদি সরকারের অন্তর্ভুক্তি অন্যান্য দেশের জন্য একটি মাপদণ্ড হতে পারে। এর ফলে সকল প্রকারের একাডেমি, নারী লিগ, পুরুষ লিগ এবং ফুটবল ফেডারেশন নিজেদের মধ্যে কোন্দলে না জড়িয়ে উন্নতির একটি রূপরেখা তৈরি করে একসঙ্গে কাজ করতে পারবে।
হাটন জানান, সৌদি লিগের ৫০ বছরের ইতিহাস রয়েছে। সাথে রয়েছে বড় ক্লাবগুলোর নিজস্ব সমর্থক। এটি একটি সত্যিকারের প্রতিযোগিতা যা তারা আরও উন্নতি করতে চেষ্টা করছে।
তার মতে, এমবাপ্পেকে নিজেদের লিগে আনার চেষ্টা করা এবং রুবেন নেভসকে সাইন করানোর ভালো দিক হল তারা শুধু পুরনো খেলোয়াড়দের দিকেই চোখ রাখছে না। সাথে তারা এটির দিকেও নজর রাখছেন যে কারা লিগকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তুলতে পারবে, নিজেদের তারকা শক্তিতে লিগের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে পারবে।
চেলসি কিংবা ম্যানচেস্টার সিটিতে যখন মালিকানা পরিবর্তন হয়ে নতুন নতুন তারকা আসায় ক্লাবগুলোর সমর্থকগোষ্ঠী অনেক আনন্দিত হয়েছিল, এখানেও ঠিক তাই। বড় বড় ক্লাবগুলোর নিজস্ব সমর্থকগোষ্ঠী আছে। যাদের সমর্থকেরা খেলা নিয়ে সত্যিকার অর্থেই মুখিয়ে থাকে।
বাণিজ্যিক লাভ
সৌদি লিগের এতো বড় বিনিয়োগ থেকে লাভের মুখ কবে থেকে আসবে জানতে চাওয়া হলে হাটন জানান, তারা যেভাবে এগুচ্ছে তাতে আগামী ৯-১০ বছরে ভালোভাবে আয় করতে পারবেন।
“এটি বোঝার গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বছরে বছরে লিগ কিভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কি পরিমাণ মানুষ খেলা দেখতে আসছে। কীভাবে টিভি স্বত্ব থেকে টাকা আসছে, স্পন্সরশিপ বাড়ছে। এটি থামার কোনো কারণই দেখছি না আমি।”
“যখন রোনালদো আল নাসেরের সাথে চুক্তিবদ্ধ হল, তখন হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টাররা আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। রোনালদো আসার পর গত বছর আমরা ১৭০টি নতুন এলাকায় (সম্প্রচারে) চলে যাই।”
মন্তব্য করুন: