মেসির রূপকথার গল্প

৩১ অক্টোবর ২০২২

মেসির রূপকথার গল্প

স্বপ্নকে যেন বাস্তবে রূপ দিলেন জাদুকর মেসি। ছবি: সংগৃহিত

বার্সেলোনার সঙ্গে লিওনেল মেসির প্রথম চুক্তি হয়েছিল ন্যাপকিন পেপারে। বিশ্ব ফুটবলের সামান্য খবর রাখলেও এই গল্প আপনার জানার কথা। কিন্তু জানেন কি, শুরুতে বার্সেলোনায় একদমই থাকতে চাননি মেসি? জানা আছে কি, মেসির ‘দ্য মেশিন অব এইটটি সেভেন’ সম্পর্কে?

রোজারিওর সান্তা ফে এলাকায় জন্ম মেসির। ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন জন্মেছেন দুনিয়াকাঁপানো ফুটবলার লিওনেল মেসি। বাড়ির সামনের রাস্তায় দৌড়ে বেড়িয়েছেন শৈশবের দিনগুলোতে। তাঁর বাড়ির সামনেই এক মাঠে কিশোরদের নিয়ে একটা ম্যাচ আয়োজিত হয়েছিল। ফুটবলপাগল মেসির পরিবারের সবাই গিয়েছিলেন ম্যাচটি দেখতে। খেলছিলেন তাঁর বড় ভাইয়েরা। বয়স কম হওয়ায় সুযোগ হয়নি মেসির। ওই সময় কোচ সালভাদোর খেয়াল করলেন একজন খেলোয়াড় কম। দেখুন কী ভাগ্য! বয়স কম হওয়ার পরও অনেকটা বাধ্য হয়ে মেসিকে মাঠে নামতে হয়। এরপর ছোট্ট মেসি যা করলেন, দর্শকদের চোখে চোখে উড়তে থাকে বিস্ময়ের রেণু।

রোজারিওর ছোট্ট মেসি।  ছবি: সংগৃহিতহামাগুড়ি দেবার বয়স থেকেই ফুটবলের প্রতি মেসির ভালোবাসা। যা সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝেন তাঁর নানী। বড় দুই ভাই ও কাজিনদের সঙ্গে মেসির খেলা দেখেই নানী সেলিয়া অলিভেইরা কুচিত্তিনি যোগাযোগ করেন স্থানীয় ক্লাব গ্রানদোলির সঙ্গে। আর্জেন্টাইন খুদে জাদুকরের প্রথম বুটজোড়াও তাঁরই কিনে দেওয়া। মেসির ফুটবল জীবনে এই মহিলা কতটা জড়িয়ে আছে, সেটা ফুটবল বিশ্ব তাঁর প্রত্যেক গোলের পরই দেখতে পান। দুই হাত উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেসি প্রত্যেকটি গোল উদযাপন করেন ১০ বছর বয়সে হারানো নানীকে স্মরণ করে। অথচ দেখুন এই নানীর মৃত্যুর পরই থেমে যেতে পারতো তার ফুটবল ক্যারিয়ার। অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতো ফুটবল ইতিহাসের একটা বড় অংশ! মেসির ওই হরেমোন সমস্যার কারণে।

নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজের একাডেমিতে দুর্দান্ত সময় কাটছিল মেসির।  ছবি: সংগৃহিতপরিবারের সবার প্রিয় ক্লাব নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজের একাডেমিতে দুর্দান্ত সময় কাটছিল মেসির। গোলের পর গোল। ১৯৯৫ থেকে গত শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত- আর্জেন্টাইন ক্লাবটির যুব দলের চিত্রই পাল্টে দিয়েছিলেন মেসি। ১৯৮৭ সালে জন্ম নেওয়া খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে গড়া দলটি ছিল অজেয়। টানা তিন বছর হারেইনি। নিউওয়েলসের দলটিকে তখন ডাকা হতো ‘লা মাকুইনা দেল এইটটি সেভেন’ বা ‘দ্য মেশিন অব এইটটি সেভেন’।

সাফল্যের বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার সময় হঠাৎ এক ঝড়ো বাতাসে সব এলোমেলো। জটিল রোগে আক্রান্ত মেসি। হরমোনের সমস্যায় আর বাড়বে না মেসির শরীর। বেজে ওঠে বিষের বাঁশি। ফুটবল ক্যারিয়ার ধ্বংসের উপক্রম। স্টিল ফ্যাক্টরিতে কাজ করা বাবা হোর্হে মেসি হেল্থ ইনস্যুরেন্সের টাকা দিয়ে দুই বছর কোনোমতে চালাতে পারলেন খরচ। মাসে ১ হাজার ডলারের চিকিৎসা খরচ মেটাতে নিউওয়েলস শুরুতে রাজি থাকলে পরে সিদ্ধান্ত বদলায়। মেসির প্র্রতিভার দাম দিতে চেয়েছিল রিভার প্লেট। কিন্তু তারাও খরচ দেখে পিছু হটে।

সব জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মাথায় হাত মেসির বাবার। নিরুপায় হোর্হে মেসির মনে হতো, পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যর্থ বাবা তিনি। স্বল্পভাষী কিশোর মেসি যেন আরও ‍চুপ। বাইরে বের হতেও বিব্রত লাগতো। তার বয়সীরা সবাই লম্বা হতে থাকলেও তিনি যে থেমে আছেন! কিন্তু তিনি তো ফুটবলদেবতা কাছ থেকে ‘সুপার পাওয়ার’ নিয়ে এসেছেন, তাঁকে আটকায় কে? তাই বার্সেলোনা থেকে খবর আসে- ‘চলে এসো কাতালান রাজধানীতে’। মেসির দাদা-দাদী বার্সেলোনাতেই থাকতেন। নাতির এই অবস্থা জেনে তাঁরা যোগাযোগ করেছিলেন বার্সেলোনা বোর্ডের এক কর্তার সঙ্গে। সাড়াও মেলে। ট্রায়ালে মেসিকে দেখে পছন্দ না হওয়ার তো কারণ নেই। কিন্তু চুক্তিতে দেরি হওয়ায় যখন অন্য ক্লাবে চলে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়, তখনই বার্সেলোনার রেস্টুরেন্টে জন্ম নেয় সেই ঐতিহাসিক ‘ন্যাপকিন-চুক্তি’। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বরে হাতের কাছে কাগজ না পেয়ে ন্যাপকিনেই হয়ে যায় বার্সেলোনার সঙ্গে মেসির প্রথম চুক্তি।

বার্সেলোনায় মেসি।  ছবি: সংগৃহিতইউরোপিয়ান ক্লাবে নাম লেখানো, চিকিৎসাও চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু ছোট্ট মেসির মন খারাপ। এতটাই যে, কারও সঙ্গে কথা বলেন না সেভাবে। সতীর্থরা তো ভেবেছিলেন, মেসি বোধহয় বোবা। হৃদয়ের বোবা কান্নায় স্বল্পভাষী মেসি চুপচাপ হয়ে যান। প্রিয় রোজারিও শহরের আলো-বাতাস টানছিল তাঁকে। পরিবার থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণায় পুড়ে যাচ্ছিল অনবরত। বাবা হোর্হে মেসি সঙ্গে আছেন, কিন্তু মায়ের সঙ্গে ভাই-বোনেরা ফিরে গেছেন আর্জেন্টিনায়। একাকী জীবনে হাঁফিয়ে উঠছিলেন মেসি। বার্সেলোনা ছেড়ে আর্জেন্টিনায় ফিরে যাওয়ার চিন্তাও মাথায় এসেছিল তাঁর!

ভাগ্যিস, সেটা হয়নি। ঋণশোধ ও ভালোবাসার টানে ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটিয়ে দিয়েছেন বার্সেলোনার আলো-বাতাসে। সময়ের হাত ধরে মেসির জাদুকরী বাঁ পায়ে লেখা হতে থাকে ইতিহাসের নতুন নতুন পৃষ্ঠা। অথচ দেখুন, ন্যু ক্যাম্পে তার শেষটা হয়েছে কী তিক্ত অভিজ্ঞতায়। বার্সেলোনা আর্থিক সংকটে না পড়লে মেসি যে পিএসজিতে যেতেন না সেই কথাটাই হয়তো বলছে এই ছবিটি।

একমাত্র ফুটবলার হিসেবে ৭ বার ব্যালন ডি’অর জিতেছেন মেসি।  ছবি: সংগৃহিতকী জেতেননি মেসি! সম্ভাব্য প্রায় সব সাফল্যই তার ছোঁয়া। এক ব্যালন ডি’অর-ই জিতেছেন সাত - সাতবার! কিন্তু সর্বকালের সেরা হতে তো বিশ্বকাপ জেতা চাই। মেসির সেটি ছিল না।

আর্জেন্টিনার জার্সিতে ২০২১ সালের কোপা আমেরিকা জয়ের আগে কিছুই তো ছিল না মেসির। ওই ট্রফিতে শিরোপার আক্ষেপ ঘুচেছে আর্জেন্টিনার, তবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারছিলেন না মেসি। ২০১৪ বিশ্বকাপে কাছে, খুব কাছে গিয়েও পারেননি। তবে ক্যারিয়ারের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপে জাদুর ছোঁয়ায় সেই আক্ষেপও দূর হলো। কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে উঁচিয়ে ধরেছেন বিশ্বকাপ। তাতে শোধ হয়েছে ফুটবলের ঋণ। সর্বকালের সেরার প্রশ্নে যাঁরা খোঁচা মেরেছেন, তাঁদের কড়া জবাব দিয়ে আনন্দের ভেলায় ভেসেছেন সোনার ট্রফি হাতে।

বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরেছেন মেসি।  ছবি: সংগৃহিতএখন তাঁকে সর্বকালের সেরা বলতে আপত্তি কোথায়! ডিয়েগো ম্যারাডোনার পর আর্জেন্টিনায় আবার ফুটবল উৎসবের উপলক্ষ এনে দেওয়া মেসি এখন লাতিন দেশটির মানুষের কাছে ‘প্রাণের প্রিয়’। ফুটবল চক্র পূরণ করে নিজেকে নিয়েছেন উঁচু থেকে আরও উঁচুতে। ফুটবল সাম্রাজ্যে মহারাজের আসনে লিওনেল আন্দ্রেস মেসি!

মন্তব্য করুন: