আইপিএলের দলগুলো আয় করে কিভাবে?

১ এপ্রিল ২০২৩

আইপিএলের দলগুলো আয় করে কিভাবে?

শুরু হয়ে গেছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ। আইপিএল। এখানে মাঠের ক্রিকেটের উত্তেজনা যেমন তুমুল, অর্থের ঝনঝনানিও তেমন প্রবল। ১০টি ফ্র্যাঞ্চাইজি অর্থ খরচ করে জলের মতো। তা কি কেবলই ক্রিকেটকে ভালোবেসে?

গত মৌসুমে নতুন দল হিসেবে নাম লেখানো গুজরাট টাইটানস ও লক্ষ্ণৌ সুপারজায়ান্টসের কথাই ধরা যাক। নিজেদের প্রথম আসরেই তারা খরচ করেছে যথাক্রমে ২২৬.৫৪ কোটি রুপি এবং ২৩৩.৬৯ কোটি রুপি।

শুধু কি তাই! ভারতীয় ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিসিআই থেকে ফ্র‍্যাঞ্চাইজির মালিকানা কিনতে খরচ করতে হয়েছে যথাক্রমে পাঁচ হাজার ছয়শত পঁচিশ কোটি রুপি এবং সাত হাজার নব্বই কোটি রুপি।

কেন এই বিপুল বিনিয়োগ?

আইপিএলের চ্যাম্পিয়ন দল তো প্রাইজ মানি হিসেবে পায় মাত্র ২০ কোটি রুপি। তাহলে ফ্র‍্যাঞ্চাইজিগুলো কেন খরচ করে এমন কাড়ি কাড়ি অর্থ? একি শুধুই ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ? নাকি একটা ব্যবসা-মডেলও আছে?

আসলে এমন বিপুল বিনিয়োগে আছে বিপুল মুনাফা অর্জনের কৌশলও। আর এটি কেবল ফ্র‍্যাঞ্চাইজি কিংবা বিসিসিআই না, এমনকি ভারতের জিডিপিতেও রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

কি সেই ব্যবসায়িক কৌশল? কিভাবে অর্থ উপার্জন করে দলগুলো? 

হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের অর্থ থেকে ফ্র‍্যাঞ্চাইজিগুলোর আয়ের প্রধান খাত তিনটি। ১. কেন্দ্রীয় রাজস্ব ২. টিম স্পন্সরশিপ ৩. টিকেট বিক্রি

১. কেন্দ্রীয় রাজস্ব: আইপিএলের আয়োজক তো ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। টুর্নামেন্ট থেকে তাঁদের কেন্দ্রীয় রাজস্বের একটা অংশ পায় ফ্র্যাঞ্চাইজি। এখানে আবার মূলত দুটো ভাগ। সম্প্রচার স্বত্ত্ব ও টাইটেল স্পন্সরশিপ।

পাঁচ বছরের জন্য আইপিলের সম্প্রচার স্বত্ত্ব পেয়েছে ডিজনি স্টারসম্প্রচার স্বত্ত্ব: ২০০৮ সালে শুরুর পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আইপিএলের ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে সনি চ্যানেলে। সনি নেটওয়ার্ক বিসিসিআই থেকে এই টেলিভিশন সম্প্রচার স্বত্ত্ব কিনে নেয় ৮ হাজার কোটি রুপির বিনিময়ে।

২০১৭-২০২২ এই পাঁচ বছরের জন্য সম্প্রচার স্বত্ত্ব পায় স্টার স্পোর্টস নেটওয়ার্ক। ১৬ হাজার কোটি রুপিতে।

আর ২০২৩-২০২৭ এই পাঁচ বছরের জন্য আইপিলের সম্প্রচার স্বত্ত্ব পেয়েছে ডিজনি স্টার, ভায়াকম১৮ এবং টাইমস ইন্টারনেট। বিনিময়ে গুণতে হয়েছে রেকর্ড ৪৮ হাজার ৩ শত ৯০ কোটি রুপি।

এখন এই সম্প্রচার স্বত্ত্ব তো বিক্রি করে ভারতীয় বোর্ড। তাতে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর লাভ কোথায়? লাভ আছে। আইপিএলের মডেল অনুযায়ী, সম্প্রচার স্বত্ত্ব বিক্রির বিনিময়ে পাওয়া অর্থের ৫০ শতাংশ বিসিসিআই এবং বাকি ৫০ শতাংশ ভাগ করে দেয়া হয় ফ্র‍্যাঞ্চাইজিগুলোকে।

এক্ষেত্রে প্লে-অফে খেলা ৪ দল অন্য দলগুলোর তুলনায় অর্থ বেশি পায়। আবার ফাইনাল খেলা দু’দল পায় সবচেয়ে বেশি। পয়েন্ট টেবিলে অবস্থান অনুযায়ী অর্থ পায় দলগুলো। এখান থেকেই আসে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের আয়ের বড় অংশ।

বর্তমান স্পন্সর ‘টাটা’ প্রতি মৌসুমে দিচ্ছে ৩৩০ কোটি রুপিটাইটেল স্পন্সরশিপ: টুর্নামেন্টের নামটাও বিক্রি করে বিসিসিআই। আইপিএলের আগে ওই স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের নাম জুড়ে হয় প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিক নাম। ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত আইপিএলকে বলা হতো ‘ডিএলএফ আইপিএল’। এরপর ‘পেপসি আইপিএল’, ‘ভিভো আইপিএল’, ‘ড্রিম ইলেভেন আইপিএল’ হয়ে এখন ‘টাটা আইপিএল’। 

এটাই টাইটেল স্পন্সরশিপ। নামদামী কোম্পানি এবং শিল্পগোষ্ঠী আইপিএল-এর সঙ্গে নিজেদের নাম জুড়ে প্রচারণার কাজ চালাতে চায়। এজন্য অবশ্য অন্য নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লড়াই আছে। সে কারণে টাইটেল স্পন্সরশিপের অর্থও বাড়ছে ক্রমশ। 

বর্তমান স্পন্সর ‘টাটা’ এজন্য প্রতি মৌসুমে দিচ্ছে ৩৩০ কোটি রুপি। এবং এই অর্থেও ভারতীয় বোর্ড ও ফ্র্যাঞ্চাইজিদের হিস্যা ফিফটি-ফিফটি।

এছাড়াও ম্যাচ চলাকালীন সময়ে স্ট্র‍্যাটেজিক টাইম আউট স্পন্সর, পাওয়ার প্লে স্পন্সর সহ আরও বেশ কিছু স্পন্সরশিপ কেন্দ্রীয় রাজস্বের অধীনে। সবগুলোতেই বিসিসিআই-ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সমান ভাগ।

প্রতি বছর আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর আয়ের ৬০-৭০ ভাগই আসে কেন্দ্রীয় রাজস্ব থেকে।

কেন্দ্রীয় রাজস্বের বাইরে ফ্র‍্যাঞ্চাইজিদের আয়ের দ্বিতীয় উৎস ব্র‍্যান্ড স্পন্সরশিপ২. টিম স্পন্সরশিপ: আইপিএলে প্রতি মৌসুমে গড়ে প্রতিটি দল দুইশত কোটি রুপি খরচ করে। প্লেয়ার কেনা, তাঁদের বেতন, হোটেলে রাখা, ভেন্যুতে ভেন্যুতে যাতায়াত, নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণসহ আরও বেশ কিছু খাতে এসব অর্থ খরচ হয়।

কেন্দ্রীয় রাজস্বের বাইরে ফ্র‍্যাঞ্চাইজিদের আয়ের দ্বিতীয় উৎস ব্র‍্যান্ড স্পন্সরশিপ। আইপিএলে প্রতি ম্যাচে খেলোয়াড়দের জার্সিতে গড়ে ৮টি ব্র‍্যান্ডের নাম বা লোগো দেখা যায়। ব্র‍্যান্ডগুলো নিজেদের প্রচারণার জন্য খেলোয়াড়দের পোশাক, ব্যাট, হেলমেটে নিজেদের নাম জুড়ে দেয়। বিনিময়ে দলগুলোকে দেয় মোটা অঙ্কের অর্থ। দলের ব্র‍্যান্ড ভ্যালু, ক্রিকেটারদের ব্র‍্যান্ডভ্যালু, নাম/লোগো বসানোর স্থানের উপর নির্ভর করে অর্থের পরিমাণ। 

এছাড়াও অনেক ব্র‍্যান্ড ক্রিকেটারদের বিজ্ঞাপন তৈরিতে ব্যবহার করেন। এ অর্থও চলে যায় ফ্র‍্যাঞ্চাইজি মালিকের কাছে।

এছাড়াও যে দলের মাঠে খেলা হয়, সে মাঠের সীমানা দড়ি থেকে শুরু করে মাঠের যেসব স্থানে বিভিন্ন ব্র‍্যান্ডের প্রচারণা চালানো হয়। এসবের মাধ্যমেও অর্থ উপার্জন করেন ফ্র‍্যাঞ্চাইজি মালিকেরা।

প্রতি মৌসুমে ফ্র‍্যাঞ্চাইজি আয়ের ২০-৩০ শতাংশ আসে এসব স্পন্সরশিপের এর মাধ্যমে।

৩. টিকেট বিক্রি: আইপিএলে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে সিস্টেম ফিরে এসেছে। এভানে হোম টিমের আয়ের একটা অংশ আসে টিকেট বিক্রি থেকে।

খেলা যদি ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে হয়, তাহলে সে ম্যাচের টিকিট বিক্রির ৮০ শতাংশ অর্থই পাবে হোম টিম মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স এর ফ্র‍্যাঞ্চাইজি। আর বাকি ২০ শতাংশ অর্থ চলে যায় রাজ্যের ক্রিকেট এসোসিয়েশনের কাছে।

এছাড়াও খেলা চলাকালীন সময়ে স্টেডিয়ামে খাবার ও পানীয় বিক্রি থেকেও কিছু আয় হয় হোম ফ্র‍্যাঞ্চাইজির। এক্ষেত্রে মাঠের দর্শক ধারণ ক্ষমতা, দলের জনপ্রিয়তা এবং ম্যাচের গুরুত্ব অনুসারে টিকিটের দামও নির্ধারণ করে ফ্র‍্যাঞ্চাইজিগুলো।

প্রতি মৌসুমে আয়ের ১০ শতাংশ আসে টিকিট বিক্রিসহ এসব খাত থেকে।

ফ্র‍্যাঞ্চাইজিগুলোর আয়ের মূল উৎস মূলত এই তিনটিই। এর বাইরেও আরও কিছু উপায়ে আয় করে তারা। তেমন আরও কয়েকটি বিষয় এখানে: 

প্রতিটি দলই তাদের মূল দলের জার্সির রেপ্লিকা বিক্রি করে সমর্থকদের জন্যমার্চেন্ডাইজ বিক্রি: প্রতিটি দলই তাদের মূল দলের জার্সির রেপ্লিকা বিক্রি করে সমর্থকদের জন্য। ঘড়ি, রিস্টব্যান্ড, মোবাইলের কাভার, টি-শার্ট সহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করে দলের নাম ও লোগো দিয়ে। এসব পণ্য বিক্রির অর্থও পায় ফ্র‍্যাঞ্চাইজি মালিকরা। মোট আয়ের পাঁচ শতাংশ এসব পণ্য বিক্রি থেকে আসে। 

প্রাইজ মানি: আগেই বলা হয়েছে, আইপিএলে চ্যাম্পিয়ন দলের প্রাইজ মানি ২০ কোটি রুপি। এছাড়া রানার আপ এবং প্লে অফে খেলা বাকি দু দলের জন্যও নির্ধারিত রয়েছে নির্দিষ্ট অর্থ।

এসব প্রাইজ মানির অর্ধেক চলে যায় ফ্র‍্যাঞ্চাইজি মালিকের কাছে। বাকি অর্ধেক দলের খেলোয়াড় এবং কোচিং স্টাফদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়।

নিজেদের ব্র‍্যান্ডের প্রচারণা: অধিকাংশ আইপিএল ফ্র‍্যাঞ্চাইজি মালিকই হয় বৃহৎ ব্যবসায়ী নয়তো শিল্পগোষ্ঠীর অধিকারী।  আর তাই দলের ক্রিকেটাররা শুধু যে স্পন্সরদের বিজ্ঞাপনেই অংশ নেয় এমন নয়। ফ্র‍্যাঞ্চাইজির বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন এবং প্রচারণায়ও থাকেন তাঁরা। এ লাভটাও তো কম নয়!

২০০৮ সালে শুরু পর থেকেই আইপিএল তুমুল জনপ্রিয়তা এবং সফলতার সাথে এখনও টিকে আছে। এমনকি প্রথম মৌসুম খেলা বেশিরভাগ দলই রয়ে গেছে। ব্যবসায়িক সাফল্য ছাড়া তো সেটা সম্ভব না। আর দিন দিন আইপিএল দলগুলো নিজেদের ব্র‍্যান্ডভ্যালু নিয়ে যাচ্ছে অনন্য চূড়ায়।

এ টুর্নামেন্টের সম্প্রচার স্বত্ত্ব পেতে তাই পঞ্চাশ হাজার কোটি রুপি খরচেও দ্বিধা করছে না। কেননা এতে রয়েছে মুনাফার নিশ্চয়তা। এই যেমন গত বছরই আইপিএল ম্যাচ চলাকালীন ১০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনী স্লট পেতে গুনতে হয় গড়ে প্রায় ১৫ লাখ রুপি! ভাবা যায়!

ক্রিকেটীয় রোমাঞ্চ ও ব্যবসায়িক সাফল্যের রসায়নে এভাবেই এগিয়ে চলেছে আইপিএল।

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Add