ম্যাককালামের ব্যাটিং দেখে স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা রুতুরাজ

৩ এপ্রিল ২০২৩

ম্যাককালামের ব্যাটিং দেখে স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা রুতুরাজ

২০০৩ সালের ঝলমলে এক দুপুর। বিশ্বকাপ সামনে রেখে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলছে ভারত-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড। এই সিরিজেরই অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার খেলা হচ্ছে পুনের নেহেরু স্ট্যাডিয়ামে। খেলা দেখতে অসংখ্য দর্শকের সাথে বাবার হাত ধরে মাঠে হাজির  পাঁচ বছরের এক বালক।

ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের ব্রেন্ডন ম্যাককালাম অস্ট্রেলিয়ার দুর্দান্ত গতির বোলারদের তুলোধুনো করে চলেছেন। আর এমন ভয়ডরহীন ব্যাটিং গ্যালারিতে বসে মুগ্ধ চোখে চোখে দেখছে ওই ছেলেটি। 

ম্যাককালামের এমন সাহসী ব্যাটিং দেখে পাঁচ বছরের বালকটি ভাবে, সেও একদিন ক্রিকেটার হবে। ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে মারবে চার-ছক্কা। অমন ব্যাটিং দেখে অবাক বিস্ময়ে করতালি আর চিৎকারে ফেটে পড়বে গোটা স্টেডিয়াম।

রুতুরাজের ক্রিকেটার হবার ভ্রমণটি তাঁর ব্যাটিংয়ের মতোই রোমাঞ্চকরপাঁচ বছরের সেই ছেলেটিই রুতুরাজ গায়কোয়াড়। চেন্নাই সুপার কিংসের ওপেনার। এবারের আইপিএলের প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরিটা পেতে পেতেও পাননি। তবে ৫০ বলে ৯২ রানের বিস্ফোরক ইনিংসে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন আবারও।

এই রুতুরাজের ক্রিকেটার হবার ভ্রমণটি তাঁর ব্যাটিংয়ের মতোই রোমাঞ্চকর।

পুনের মধ্যবিত্ত এক পরিবারে জন্ম রুতুরাজের। বাবা দশরথ গায়কোয়াড় ছিলেন সামরিক বাহিনীর একজন গবেষক। মা সবিতা গায়কোয়াড় শিক্ষিকা। এমন একটা পরিবার তো সন্তানের পড়াশোনার দিকেই মনোযোগ দেবে। রুতুরাজের মা-বাবাও চেয়েছিলেন, ছেলে ভালোভাবে পড়ালেখা শেষে ভালো চাকরি করবে। 

তবে রুতুরাজের মন তো পড়ে রয়েছে ক্রিকেটে। একান্নবর্তী পরিবারে কারোরই ক্রিকেট সম্পর্কে তেমন আগ্রহ না থাকলেও নিজের স্বপ্নে তিনি অবিচল। মা-বাবা ক্রিকেট নিয়ে ততটা আশাবাদী না হলেও ছেলের স্বপ্নে বাধা দেননি। শুরু হয় রুতুর ক্রিকেটার হবার যাত্রা।

অনুন্নত অঞ্চলে বসবাস হওয়ায় ক্রিকেট প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ কখনই পাননি রুতু। চামড়ার পুরনো বল দিয়ে নিজে নিজেই খেলতেন। কখনো বাবা কিংবা পরিবারের অন্য ভাইদের পেতেন সঙ্গী হিসেবে।

এগারো বছর বয়সে প্রথম কোনো ক্রিকেট একাডেমিতে যোগ দেন রুতুরাজএগারো বছর বয়সে প্রথম কোনো ক্রিকেট একাডেমিতে যোগ দেন রুতুরাজ। আর তার ক্রিকেটীয় জীবনের প্রথম সাফল্য আসে ২০১৪-১৫ মৌসুমে কুচবিহার ট্রফিতে, ওডিশ্যার বিপক্ষে ম্যাচে মহারাষ্ট্রের হয়ে সেঞ্চুরি; রুতুরাজের প্রথম সেঞ্চুরি এটিই। এরপরই মূলত ক্রিকেটকে ভবিষ্যত হিসেবে নিয়ে আশাবাদী হন তিনি। একই টুর্নামেন্টে পরের বছরও আশাতীত ভালো করায় মহারাষ্ট্রের হয়ে ‘লিস্ট এ’ ক্রিকেট খেলার সুযোগ হয় মহেন্দ্র সিং ধোনির ভক্ত রুতুর।

মহারাষ্ট্রের সাথে  ঝাড়খন্ডের খেলায়, ঝাড়খণ্ড দলের মেন্টর ধোনিকে ‘লিস্ট-এ’ এর খেলায় মুগ্ধ করার ইচ্ছা রুতুর। কিন্তু প্রথম বলেই আঙুলে ব্যাথা পান। এরপর সুস্থ হয়ে ফিরলেও পরিস্থিতি আগের মত ছিল না। মিডল অর্ডারে খেলা রুতুকে খেলতে হলে ব্যাটিং করতে হবে ওপেনিংয়ে। দলে ওপেনিং ছাড়া আর কোনো জায়গা খালি না থাকায় সে সুযোগই লুফে নেন তিনি । আর এ সুযোগে দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করায় ওপেনার হিসেবেই দলে জায়গা পাকাপোক্ত হয়ে যায় রুতুর।

ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ছিল। সুযোগ চলে আসে আইপিএলেও। ২০১৯ সালে ২০ লাখ রুপিতে রুতুরাজকে দলে নেয় চেন্নাই। কিন্তু পুরো মৌসুমে একটি ম্যাচেরও জন্যও একাদশে সুযোগ পাননি।

করোনার কারণে ২০২০ আইপিএল হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এ আসরে চেন্নাইয়ের ওপেনার হিসেবে খেলার কথা রুতুরাজের। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর ঠিক আগে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হন। ফলে খেলতে পারেননি শুরুর দিকের ম্যাচগুলো। সুস্থ হয়ে ফিরে ৬ ম্যাচে পাঁচ ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ হয়। পর পর দুই ম্যাচে পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলে চেন্নাইয়ের জয়ে ভূমিকা রাখেন তিনি।

আইপিএলে রুতুরাজের প্রতিভার পরিপূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায় ২০২১ আসরে। ১৬ ম্যাচ খেলে আসর সর্বোচ্চ ৬৩৫ রান করেন; পান অরেঞ্জ ক্যাপ। সেবার চেন্নাইয়ের শিরোপা জয়ে বড় ভূমিকা এ ওপেনিং ব্যাটসম্যানের। সুযোগ চলে আসে জাতীয় দলেও। তবে ভারতের জার্সিতে এক ওয়ানডে ও ৯ টি-টোয়েন্টিতে সেভাবে হাসেনি রুতুর ব্যাট। ওয়ানেডের একমাত্র ইনিংসে ১৯ রান এবং টি-টোয়েন্টিতে ৮ ইনিংসে এক ফিফটিতে ১৩৫ রান মাত্র।

আইপিএলে রুতুরাজের প্রতিভার পরিপূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায় ২০২১ আসরেভারতীয় দলের ওপেনারের লড়াইয়ে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো আছেই। সঙ্গে দুর্ভাগ্যও আছে রুতুরাজের। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে দলে থাকলেও কবজির ইনজুরির কারণে ছিটকে যান। একই ঘটনা এ বছরও। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে খেলার পথেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেই কবজির পুরনো ইনজুরি।

ইনজুরি থেকে ফিরে এবারের আইপিএলের প্রথম ম্যাচেই ৯২ রানের ইনিংস। সেঞ্চুরি পাননি সেদিন। তবে চেন্নাইয়ের হয়ে আইপিএলে সেঞ্চুরি করা তিন ব্যাটসম্যানের একজন রুতুরাজ। আইপিএলে সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে হাজার রান করা ক্রিকেটারও তিনি।অবশ্য এ রেকর্ডটি তিনি ভাগাভাগি করছেন টেন্ডুলকারের সাথে।

রুতুরাজ এবারের আইপিএল শুরু করেছেন দারুণভাবে। ২০২১ আইপিএলের মতো আরেকটা আসর কাটবে নাকি? জাতীয় দলে থিতু কি হতে পারবেন? ভিনদেশী এক ক্রিকেটার যে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিল পাঁচ বছরের এক বালকের মনে, সে স্বপ্নের পূর্ণতা কি পাবে? ভারতের আগামী দিনের ওপেনার কি হতে পারবেন রুতুরাজ গায়কোয়াড়? 

উত্তরটা সময়ের হাতে। তবে পুনের অনুন্নত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা ছেলেটি যে হারার আগে হারে না, সেটি তো দেখিয়েছেন তিনি। ক্যারিয়ারজুড়ে। জীবনজুড়েও।

মন্তব্য করুন: