নেইমারের চাই বিশ্বকাপ

৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

নেইমারের চাই বিশ্বকাপ

আপনি কি জানেন, মাত্র ৪ মাস বয়সে মারা যেতে পারতেন নেইমার? জানেন, ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড যখন পেটে, তখন টাকার অভাবে আলট্রাসনোগ্রাম করাতে পারেননি তাঁর মা? জানেন কি, তাঁর শৈশবে মাত্র ছয় ফুটের একটা ম্যাট্রেসে পুরো পরিবারকে ঘুমাতে হয়েছে? অথচ দেখুন। জীবন কত বিচিত্র! কালে কালে সেই নেইমার হয়ে উঠলেন সমকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার। সেই নেইমারের একটা বাড়ির দামই এখন ৮২ কোটি টাকা!

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। গাড়ি চালাচ্ছিলেন নেইমার সিনিয়র। গাড়িতে তাঁর স্ত্রী নাদিন এবং চার মাসের ছোট্ট সন্তান নেইমার জুনিয়র। আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছিলেন বেড়াতে। ফুরফুরে মেজাজে তাই পুরো পরিবার। এমন সময় হুট করেই বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ। বিকট আওয়াজ। কী হলো, কীভাবে হলো, বুঝে উঠতে পারলেন না নেইমার সিনিয়র। কানের ভেতর চিনচিন শব্দে খানিক সময়ের জন্য মনে হলো, হয়তো বেঁচে নেই তিনি। ‘নাদিন, আমি মারা যাচ্ছি’- বলার পরপরই চিৎকার, ‘আমার ছেলে কোথায়?’

কোলে শিশু নেইমার।  ছবি: সংগৃহিতনেইমারের মা উল্টে যাওয়া গাড়ির কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসেন প্রথমে। এরপর বের করে আসেন ছোট্ট সন্তানকে। তাঁর সারা গা ভিজে যাচ্ছিল রক্তে। অ্যাক্সিডেন্ট দেখে দৌড়ে আসা লোকজন বিধ্বস্ত গাড়ির ভেতর থেকে উদ্ধার করেন নেইমার সিনিয়রকে। নিজের পা ভেঙে গেলেও ৪ মাসের সন্তান নেইমারের বড় ক্ষতি হয়নি দেখেই হাঁফ ছাড়েন তিনি। এভাবেই মাত্র ৪ মাস বয়সে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান নেইমার। পরবর্তীতে যিনি অলৌকিক ফুটবলে মাতিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ব।

বল পায়ে নেইমার অপূর্ব। নেইমার অনবদ্য। তিনি শিল্পী। তিনি জাদুকর। তাঁর জাদুকরীতে বিমোহিত বিশ্ব। তাঁর কারিকুরিতে মুগ্ধ সবাই। কিন্তু নেইমারের জীবনের শুরুটা আর দশটা সাধারণ ব্রাজিলিয়ানের মতোই। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ের। ফুটবলে আশ্রয় খোঁজার। ব্রাজিলের ফাভেলা, মানে আমাদের বস্তি। সাও পাওলোর মগি দাস ক্রুজের এই বস্তিতে জন্ম নেইমারের। তাঁর বাড়ির কাছেই যে ডাম্পিং গ্রাউন্ড, সেখানে ফেলার হতো শহরের যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা।

এ শহরের রাস্তাতেই নেইমারের ফুটবলের প্রেমে পড়া। ফুটবলটা আসলে তাঁর রক্তেই ছিল। বাবা নেইমার সিনিয়র খেলতেন ব্রাজিলের নিচু সারির লিগে। যে গাড়ি দুর্ঘটনার কথা বলছিলাম, তাতে যে হাড় ভাঙে, ওখানেই নেইমার সিনিয়রের ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ।

৬ বছর বয়সেই ফুটবলের পথ তৈরি হয় নেইমারের।  ছবি: সংগৃহিতএরপর নিজের স্বপ্ন ছড়িয়ে দেন ছেলের মধ্যে। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। ছোট্ট নেইমারের গোল কিছু পেলেই হলো। বেলুনে লাথি মারার মধ্যেও ছিল অন্যরকম কারুকার্য। ৬ বছর বয়সেই ফুটবলের পথ তৈরি হয়ে যায়। স্ট্রিট ফুটবল দিয়ে শুরু করে ফুটসালে পা। সহজাত টেকনিকের কারণে ওই বয়সেই নেইমারকে আলাদা করতে অসুবিধা হতো না।

কিন্তু দারিদ্রের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না নেইমার সিনিয়র। খেলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ায় খুঁজতে হয় নতুন চাকুরি। সে চাকুরি কিছু দিন থাকে; আবার চলে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, বাসার ইলেকট্রিসিটির বিল দিতে না পারায় কাটা পড়ে লাইন; সন্ধ্যা হলেই নেইমারদের বাসায় জ্বলে মোমবাতি। জীবনধারণ করতে যখন নাভিশ্বাস অবস্থা, বাধ্য হয়ে তাদের চলে যেতে হয় দাদাবাড়ি। ততদিনে নেইমারের ছোট বোন রাফায়েলারও জন্ম হয়েছে। দাদাবাড়িতে এক রুমে এই চারজনের পরিবারকে গাদাগাদি করে থাকতে হতো একটিমাত্র ম্যাট্রেসে!

এসব কিছুর মধ্যেও নেইমারের ফুটবল চলছিল পুরোদমে। মুগ্ধতাও ছড়াচ্ছিলেন পুরোমাত্রায়। প্রথম কোচ বেতিনহো যেমন এখনও মনে করে বলতে পারেন, ‘নেইমারকে প্রথম দেখি ৬ বছর বয়সে। একটি বিচ সকার ম্যাচে। ও যে অসাধারণ ফুটবলার, অন্য সবার চেয়ে আলাদা, সেটি প্রথম দেখাতেই বুঝে গিয়েছিলাম।’ এরপর সাও ভিসেন্তের পর্তুগিজা সানতিস্তা নামের ফুটসাল ক্লাবে নাম লেখান নেইমার। ‘বিস্ময় বালক’ হিসেবে ছড়াতে থাকে তাঁর নাম। বিখ্যাত সান্তোস ক্লাবের কাছেও পৌঁছে যায় নামটা। ২০০৩ সালে নেইমারের বয়স যখন ১২ বছর, তখন তাকে একাডেমীতে নেয় সান্তোস।

‘নতুন পেলে’ হিসেবেও ডাকা হতো নেইমারকে।  ছবি: সংগৃহিতপেলের ক্লাব সান্তোস। রবিনহোর ক্লাব সান্তোস। এখানে যোগ দিয়ে নেইমার পেয়ে যান স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি। কিছু দিনের মধ্যে ‘নতুন রবিনহো’ নাম পেয়ে গেলেন তিনি। ‘নতুন পেলে’ হিসেবেও ডাকা হতো নেইমারকে। পেলেও এই নতুন ছেলেটিকে তুমুল উল্লসিত। তখনই বোঝা যাচ্ছিল, ব্রাজিলের তারকায় ঠাসা ফুটবল-আকাশে নতুন এক তারকা আসছে।

সান্তোসের মূল দলে অভিষেক হলো নেইমারের। ব্রাজিলিয়ান ফুটবল শিল্পের সবটুকু রূপ-রং-রস নিয়ে। তাঁর ড্রিবলিংয়ে স্টেডিয়ামে ওঠে বিস্ময়ধ্বনি। তাঁর গোলে-অ্যাসিস্টে সান্তোসে জয়ধ্বনি। সাফল্যও আসতে থাকে। সেই পেলের যুগের পর, নির্দিষ্ট করে বললে ৪৮ বছর পর লাতিন আমেরিকার চ্যাম্পিয়নস লিগ ‘কোপা লিবের্তাদোরেসের শিরোপা জেতে সান্তোস। জেতান নেইমার। সান্তোস বুঝে গেল, ইউরোপিয়ান ক্লাবদের নজর এড়িয়ে এই ছেলেকে বেশি দিন ধরে রাখা যাবে না।

অবশ্য আরও বেশ আগেই ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ এসেছিল নেইমারের সামনে। সেটিও কিনা রিয়াল মাদ্রিদে! ২০০৬ সালে কিশোর নেইমার গিয়েছিলেন রিয়ালের ট্রায়ালে। টিকেও যান। কিন্তু যে প্রস্তাব দিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ, পছন্দ হয়নি নেইমারের বাবার। ফলে রিয়ালে যাওয়া হয়নি। পরবর্তীতে যে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা কিনে নেয় নেইমারকে, সেই ক্লাবে দুকূল উপচানো সাফল্য এনে দেন, মেসি-নেইমার-সুয়ারেসের ভয়ঙ্কর ত্রয়ী গড়ে ওঠে- এসব কারণে রিয়াল মাদ্রিদের আফসোস না হওয়া কারণ নেই।

বার্সেলোনায় গিয়ে নেইমারের তুমুল বন্ধুত্ব হয় লিওনেল মেসির সঙ্গে।  ছবি: সংগৃহিত

বার্সেলোনায় গিয়ে নেইমারের তুমুল বন্ধুত্ব হয় লিওনেল মেসির সঙ্গে। একজন ব্রাজিলিয়ানের সঙ্গে একজন আর্জেন্টাইনের এমন বন্ধুত্ব বেশ বিরল। কিন্তু এক সময় সেই প্রিয় বন্ধু মেসির ফুটবলীয় ছায়া থেকে সরে যাবার জন্য নেইমার চলে যান ফ্রান্সের ক্লাব পিএসজিতে। ২২২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। পাঁচ বছর আগের সেই ট্রান্সফার ফি এখনও সর্বকালের সর্বোচ্চর রেকর্ড।

সময় পরিক্রমায় সেই পিএসজিতে এখন মেসি। দুই বন্ধু আবার একসঙ্গে। এক ক্লাবে। তবে ক্লাব ফুটবল দিয়ে তো আর ফুটবল ইতিহাসের গ্রেটনেস নির্ধারিত হয় না। সেজন্য জাতীয় দলে সাফল্য চাই। নেইমার তা জানেন। ২০১৬ সালে ব্রাজিলকে ইতিহাসে প্রথম অলিম্পিক স্বর্ণপদক এনে দিয়েছেন। ব্রাজিলের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতার সিংহাসন পেলের সঙ্গে ভাগাভাগি করেছেন নেইমার।

কিন্তু সত্যিকারের গ্রেট হতে হলে তো বিশ্বকাপ জিততে হবে। ২০১৪ ও ২০১৮ বিশ্বকাপে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি নেইমার। কাতারেও ব্রাজিলের আশার আলো হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সোনালী জার্সির সোনালী প্রজাপতি। পেলে-রোনালদো-রোনালদিনহোদের ব্র্যাকেটে থাকতে হলে তো সোনার ট্রফিটা জিততেই হবে নেইমারকে। কিন্তু পারেননি নেইমার। চমৎকার ফুটবলের প্রদর্শনীতে সেলেসাওদের কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত নিয়েছিলেন, পরে আর পারেননি। শেষ আটেই শেষ হয় নেইমারের বিশ্বকাপ। অপেক্ষা এখন ২০২৬ বিশ্বকাপ।

মাত্র ৪ মাস বয়সে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা নেইমার, জীবনযুদ্ধে জয়ী নেইমার কি কখনও পারবেন ফুটবল-মঞ্চের মহাযুদ্ধটা জিততে?

মন্তব্য করুন: