কীভাবে কাজ করে ডাকওয়ার্থ - লুইস মেথড

৩১ জানুয়ারি ২০২৩

কীভাবে কাজ করে ডাকওয়ার্থ - লুইস মেথড

দু’হাজার আটের নভেম্বরে সেবার ইংল্যান্ড এসেছিল ভারত সফরে; ওই যে বার মুম্বাইয়ের হোটেল তাজ, মেট্রো সিনেমা, সিএসএমটি স্টেশনসহ আটটি ভিন্ন লোকেশনে সন্ত্রাসী হামলা হলো। যে হামলার কারণে সফরের ৭টি ওয়ানডে ম্যাচের শেষ দু’টি বাতিল করতে হয়েছিল।

ওই সিরিজেরই দু’টি ওয়ানডে ম্যাচে আবার হয়েছিল বৃষ্টির হানা। ক্রিকেট ম্যাচে বৃষ্টি বাঁধা হলে যেটা হয়ে থাকে আরকি; ডাকওয়ার্থ-লুইস বা ডিএল মেথড ব্যবহার করে রিভাইজড টার্গেট সেট করা হয়। তেমনটাই হয়েছিল। এবং ২৬ নভেম্বরের একটি প্রেস কনফারান্সে ভারতের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি বলেছিলেন, “Frankly speaking I don’t understand Duckworth-Lewis. I just wait for the umpire’s decision.”

এই এক কথাতেই নিশ্চয়ই ডিএল মেথডের জটিলতা বুঝে নেওয়া যায়। নিচের ছবিটি দেখলেও মেথডটির জটিলতা আরও বেশি আঁচ করতে পারবেন। এখানে একটি বইয়ের কাভার পেজ দেখতে পাচ্ছেন আপনি। বইটি ডিএল মেথড নিয়ে; লিখেছেন মেথডের দুই জনক। এবং বইটি ৭৬ পৃষ্ঠা দীর্ঘ! বুঝুন!

তো যে মেথডটি ধোনিসহ বিশ্বের তাবৎ সব ক্রিকেটার ও আম্পায়ররা বুঝতে পারে নি, যেটি আয়ত্ত করতে আপনাকে ৭৬ পৃষ্ঠার একটি গণিত বই পড়তে হবে; সেই মেথডের বিস্তারিত আপনি এই একটি লেখা পড়ে পুরোপুরি বুঝে ফেলবেন - এমনটি আমরা বলছি না! তবে জটিল গণিতের কঠিন হিসাব এড়িয়ে, সহজেই পদ্ধতিটির পূর্ণাঙ্গ এক নির্যাস পাবেন নিশ্চয়ই! যে বিষয়টি এতদিন আপনার কাছে হয়তো ঘন কুয়াশা আবৃত হয়েই ছিল; আজকের পর আপনার মনের সেই কুয়াশা পুরোপুরি কেটে যাবে!

উপরের ছবিটি নিশ্চয়ই আপনি কখনো না কখনো দেখেছেন! ছবির গল্পটি যাদের জানা, তারা সবাই-ই জানেন ছবিটির বিষাদের গল্প। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের এক পর্যায়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রান। আচমকা ১২ মিনিটের বৃষ্টি শেষে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখা মিললো এক আশ্চর্য দৃশ্যের! হঠাৎ দক্ষিণ আফ্রিকার ১ বলেই প্রয়োজন ২২ রান (আদতে দরকার ছিল ২১ রানের; কিন্তু জায়ান্ট স্ক্রিন ভুল করে ২২ রান দেখাচ্ছিল)!

এই ম্যাচটিতে রিভাইজড টার্গেট সেট করা হয়েছিল Most Productive Overs মেথড ব্যবহার করে। অদ্ভুত সে নিয়ম! বৃষ্টিতে যত ওভার কাটা পড়তো রান তাড়া করার সময়, প্রথমে ব্যাট করা দলের সবচেয়ে কম রান  আসা সে কয় ওভারের মোট রান বাদ যেত টার্গেট রান থেকে। এটি নিয়ে আর বিস্তারিত আলোচনা অর্থহীন; তবে মেথডটি যে অপূর্ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ তা বলাই বাহুল্য! ম্যাচটি শেষে ব্যাপক সমালোচনার মুখে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচের রিভাইজড টার্গেট সেট করার হিসাব নিয়ে নড়ে-চড়ে বসে আইসিসি।

সেই সময়েই ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ ও টনি লুইস নামের দুইজন ইংলিশ গণিতবিদ একটি মডেল প্রস্তাব করেন। তারা তাদের মডেলটি সেই ‘৯২-র ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের মাধ্যমে প্রজেক্ট করে দেখান যে, তাদের মডেল ব্যবহার করলে ওই ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ বলে জেতার জন্য দরকার পড়তো ৫ রানের। যেটা অবশ্যই Most Productive Overs মেথড থেকে অনেক বেশি প্রাক্টিকাল।

তারা দেখান যে Most Productive Overs মেথড ম্যাচ সিচুয়েশনকে কোনো কন্সিডারেশনেই নেয় না। সংশোধিত টার্গেট সেট করতে হলে, খেলা কয় ওভার বাকি থাকবে; কত উইকেট দল হারিয়েছে; ওই ম্যাচ সিচুয়েশনে অন্য দলের স্কোরকার্ড কেমন ছিল - এই প্যারামিটারগুলোকে আমলে নেওয়া উচিত। এসব কিছু মিলিয়েই তারা ১৯৯৭ সালে তাদের ডিএল মেথডটি প্রবর্তন করেন। আইসিসি যেটি ১৯৯৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে।

ডিএল মেথডে রিভাইজড টার্গেট সেট করার সময় মূলত দু’টি বিষয়ে নজর রাখতে হয়। প্রথমটি হলো বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হওয়ার সময় টিম 2 কত ওভার খেলেছে ও কতটি উইকেট হারিয়েছে। আর দ্বিতীয়টি টিম 1 কত রান করেছে, কত ওভার খেলেছে ও কত উইকেট হারিয়েছে। এখানে আগে ব্যাট করা দলকে টিম 1 এবং পরে ব্যাট করা দলকে টিম 2 হিসেবে ডাকা হয়ে থাকে।

ডিএল পদ্ধতি বুঝতে হলে প্রথমেই একটি কিওয়ার্ড বুঝে নিতে হবে - ‘অ্যাভেইলএবল রিসোর্সেস’। একটি দলের হাতে যত বেশি ওভার ও যত বেশি উইকেট বাকি থাকবে; দলটির অ্যাভেইলএবল রিসোর্সেস তত বেশি হবে। সেটাই কি হওয়া উচিত না?

নিচের ছবিটি দেখুন। এখানে কত ওভার ও কত উইকেট বাকি থাকলে কেমন রিসোর্স হবে সেটি দেওয়া আছে। ডাকওয়ার্থ ও লুইস সাহেব তাদের বইতে এই চার্ট দিয়ে গিয়েছিলেন। এই যে কত ওভার ও কত উইকেট বাকি থাকলে অ্যাভেইলএবল রিসোর্সেস কী হবে - সেটি বের করার কাজটি করতেই কিন্তু জটিল গণিতের কঠিন তত্ত্বের কথাটি এসে থাকে। এই চার্টটি তৈরি করতে স্ট্যাটিস্টিকস, কম্বিনেটরিক্স কিংবা প্রোবাবিলিটির মতো কাঠখোট্টা সব গণিতের ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে। আমরা যেহেতু চার্টটি আর নতুন করে বানাচ্ছি না; তাই সাহস করে আপনাদের বলতে পারছি যে এই লেখা পড়লে আপনি ডাকওয়ার্থ-লুইস নিয়ে অনেক কিছুই বুঝতে পারবেন।

আরেকটি কথা… আজকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আইসিসি কিন্তু এই চার্টটি ব্যবহার করে না। তারা যে চার্টের ব্যবহার করে; সেটি আইসিসির সফটওয়্যারেই শুধু লোড করা থাকে। এবং সেটি পাব্লিকলি অ্যাভেইলএবল না। তবে সংখ্যাগুলো এই চার্টের আশেপাশেই কিছু হবে সেটি আন্দাজ করে নেওয়া যায়।

সে যাই হোক। রাফ হিসেবটা একবার বুঝে নেই চলুন!

ধরুন, এপ্রিল মাসে ভারত এসেছে বাংলাদেশ সফরে। বুঝতেই পারছেন কালবৈশাখীর সময়। ঝড়-বৃষ্টি হানা দিতে বাধ্য! তো, আগে ব্যাটিংয়ে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভার খেলে ভারত করলো ৮ উইকেটে ২৫০ রান। যেহেতু এই ইনিংসে বৃষ্টির কোনো ইন্টারাপশন ছিল না। তাই, তাদের অ্যাভেইলএবল রিসোর্সেস কিন্তু সম্পূর্ণ ১০০%। মনে রাখবেন, ছবির চার্ট থেকে রিসোর্স আমরা তখনই নিবো; যখন পূর্ণ ওভারের খেলা বাঁধাগ্রস্থ হবে। অর্থাৎ, ইনিংস থেকে ওভার কাটা পড়বে।

যাই হোক… এরপর বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামলো। ১২ ওভারের খেলা হতে হতেই বৃষ্টি শুরু হলো। এই ১২ ওভারে বাংলাদেশ ১ উইকেট হারিয়ে ৪০ রান করেছে। এবারে ছবিতে দেখুন, যেহেতু বাংলাদেশের হাতে এখনো ৩৮ ওভার বাকি; এবং তারা উইকেট হারিয়েছে ১টি। তাই বাংলাদেশের এ মূহুর্তে অ্যাভেইলএবল রিসোর্সেস ৮২%।

এবার ধরুন, বৃষ্টিতে বাংলাদেশের ইনিংসের ১০ ওভার কাটা পড়লো। তাহলে, বাংলাদেশকে আসলে খেলতে হবে কত ওভার? ৩৮ বিয়োগ ১০। মানে ২৮ ওভার। তাই নয় কি? এই ২৮ ওভারের জন্য বাংলাদেশের অ্যাভেইলএবল রিসোর্সেস কত হবে? দেখুন এই ছবিতে, ৬৮.৮। ১০ ওভারের সাসপেনসন না হলে বাংলাদেশের রিসোর্স হতো ৮২%; আর সাসপেনশন হওয়ায় রিসোর্স হচ্ছে ৬৮.৮%। পার্থক্য কতো? ১৩.২%। ১০০% থেকে এই ১৩.২% বিয়োগ করলে যা থাকবে, সেটাই বাংলাদেশের আসল অ্যাভেইলএবল রিসোর্সেস। সেটা হলো, ৮৬.৮%।

এবার নিচের হিসাবটি দেখুন। এখানে প্রথমে বাংলাদেশের রিসোর্স থেকে ভারতের রিসোর্স ভাগ করা হয়েছে। অর্থাৎ ৮৬.৮ ভাগ ১০০। পেয়েছি ০.৮৬৮। তারপর ভারত প্রথম ইনিংসে যত রান করেছিল, অর্থাৎ ২৫০; সেই ২৫০-এর সাথে গুণ করেছি। স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছেন যে হিসাব শেষে পেয়েছি ২১৭। এই ২১৭ যোগ ১, অর্থাৎ ২১৮ রানই হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন টার্গেট।

তাহলে ম্যাচ জিততে বাংলাদেশেকে বাকি ২৮ ওভারে (যেহেতু ১২ ওভারের খেলা হয়ে গিয়েছে) করতে হবে ১৭৮ রান (টার্গেট ২১৮)।

নিশ্চয়ই আপনি হিসাবটা বুঝতে পেরেছেন? খুবই মামুলী কিছু যোগ-বিয়োগের খেলা!

এবার যদি এমন ঘটে যে খেলা আর মাঠেই গড়ালো না? তখন কী হতো? তখন কিন্তু বাংলাদেশের ওভারস লেফট হতো ০। তাই রিসোর্সও হতো ০। ওই শুরুর ৮২ থেকে (পূর্ণ ৫০ ওভার কন্সিডার করে যেই রিসোর্স ছিল আরকি) ০ বিয়োগ করলে ৮২-ই থাকে। ১০০ থেকে ৮২ বাদ দিলে পাই ১৮।

এই ১৮ থেকে ১০০ ভাগ করে ২৫০ এর সাথে গুণ করলে পাই ৪৫। অর্থাৎ, ওই বৃষ্টিতে খেলা আর মাঠে না গড়ালে বাংলাদেশের টার্গেট হতো ৪৫ + ১ = ৪৬। বাংলাদেশ করেছে ৪০। ডিএল পার থেকে ৫ রানে পিছিয়ে রয়েছে। তার মানে কিন্তু, বৃষ্টিতে খেলা আর মাঠে না গড়ালে ভারতকে ৫ রানে জয়ী ঘোষণা করা হবে।

এটিই কিন্তু এতদিন আপনার কাছে রহস্য হয়ে থাকা সেই ডিএল মেথড। হিসাব কিন্তু আসলেই তেমন একটা কঠিন না। মহেন্দ্র সিং ধোনি বুঝতে না পারলেও আপনি নিশ্চয়ই আজ থেকে বুঝে নিতে পারবেন। আর কিছু হোক না হোক, কোনো ম্যাচে ডিএল মেথডে টার্গেট সেট হলে টার্গেটটি এমন কেন হলো সেটুকু তো অন্তত বুঝতেই পারবেন!

শেষ করার আগে শুধু একটি তথ্য - এখন কিন্তু দেখবেন ডিএল মেথডকে সব জায়গায় ডিএলএস মেথড বলা হয়। ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান প্রফেসর স্টিভেন স্টার্ন ডিএল মেথডে কিছু হালনাগাদ করলে, তখন থেকে এই মেথডকে ডিএলএস মেথড নামে ডাকা হয়ে থাকে।

মন্তব্য করুন: