রকিবুলের ব্যাটে “জয় বাংলা”

অর্ঘ্য প্রতীম ঘোষ

২৬ মার্চ ২০২৩

রকিবুলের ব্যাটে “জয় বাংলা”

রকিবুলের ‘জয় বাংলা’ আঁকা ব্যাট (অলংকরণে অর্ঘ্য প্রতীম ঘোষ)

ব্যাটে স্পন্সরের লোগো সম্বলিত স্টিকার তো দেখা যায় হরহামেশা। কিন্তু সেদিন ওই তরুণ ক্রিকেটার রকিবুল হাসানের ব্যাটে দেখা যায় ব্যতিক্রমী সেই স্টিকার। ঢাকা স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজার পনেরো দর্শক একযোগে গর্জে ওঠে স্টিকারে লেখা “জয় বাংলা” স্লোগানে। রকিবুল হাসানের ক্রিকেট ব্যাট হয়ে যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গর্জন। 

পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন তুমুল অস্থিরতা। সবে নির্বাচন শেষ হয়েছে, বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা করছে সরকার। রাজপথে উত্তাপ স্পষ্ট। এমনই এক সময়ে পূর্বানী হোটেলের এক রুমে শেখ কামালের সাথে তুমুল আলোচনায় মগ্ন তরুণ রকিবুল। কিছুক্ষণ আগেই তিনি সাহসী এক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

পরদিন ২৬ শে ফেব্রুয়ারি কমনওয়েলথ একাদশের সাথে পাকিস্তান দলের ম্যাচ ঢাকা স্টেডিয়ামে। একমাত্র বাঙালি হিসেবে পাকিস্তান দলে ডাক পেয়েছেন আঠারো বছর বয়সী রকিবুল। দুই দলই উঠেছিল পূর্বানী হোটেলে। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ক্রীড়াপাগল মানুষ। নিজেও খেলতেন। বন্ধুদের নিয়ে তাই হোটেলে যান রকিবুলকে শুভেচ্ছা জানাতে। সেই সুযোগেই রকিবুল শেখ কামাল কে জানান তিনি পরের দিন মাঠে নামতে চান ‘জয় বাংলা’ লেখা স্টিকার ব্যাটে লাগিয়ে। কারণ সেখানে সংবাদমাধ্যম থাকবে, গ্যালারিভর্তি দর্শক থাকবে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি পাবে তাই ভিন্ন মাত্রা।

রকিবুল শেখ কামাল কে জানান তিনি পরের দিন মাঠে নামতে চান ‘জয় বাংলা’ লেখা স্টিকার ব্যাটে লাগিয়ে। কারণ সেখানে সংবাদমাধ্যম থাকবে, গ্যালারিভর্তি দর্শক থাকবে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি পাবে তাই ভিন্ন মাত্রা।

কিন্তু অমনটা করলে তো শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে পড়ার আশঙ্কা। রকিবুল তবুও সিদ্ধান্তে অটল। কেন নিয়েছিলেন তিনি অমন সিদ্ধান্ত?

ওই ম্যাচের জন্য পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের যে ব্যাট দেয়া হয়, তাতে তলোয়ারের স্টিকার। সেটি পাকিস্তান পিপলস পার্টির নির্বাচনী প্রতীক। তলোয়ারের সেই স্টিকার দেখেই রকিবুলের মনে আসে এমন চিন্তা! ‘জয় বাংলা’ তখন পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষের স্লোগান। ব্যাটে এই স্লোগান নিয়ে মাঠে নামলে যে তা সহজেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নজর কাড়বে তা তিনি জানতেন।

রকিবুলের পরিকল্পনা শুনে সেদিন সন্ধ্যায় শেখ কামাল তো খুবই খুশি। তখনই ছাত্রনেতা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে আওয়ামী লীগ অফিসে পাঠিয়ে আনানো হয় ‘জয় বাংলা’ সম্বলিত স্টিকার। রকিবুল তাঁর ‘গান এন্ড মুর’ ব্যাটে লাল সবুজ পতাকার নিচে জয় বাংলা লেখা স্টিকার লাগিয়ে প্রস্তুত হন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে মাঠে নামার জন্য।

‘জয়বাংলা’ স্টিকার লাগিয়ে খেলতে নেমেছিলেন রকিবুল হাসান (দাঁড়িয়ে ডান দিক থেকে চতুর্থ)

ওপেনার হিসেবে রকিবুলের সাথে মাঠে নামেন আজমত রানা। মাঠে নামার সময়ই রকিবুলের ব্যাটের ‘জয় বাংলা’ ফটোসাংবাদিকদের নজর কাড়ে। তাকে থামানো হয় ছবি তুলতে। পুরো স্টেডিয়ামে ঘটনাটি জানাজানি হতে সময় লাগে না। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে গর্জে ওঠে গ্যালারি। খেলা ছাপিয়ে মাঠে সেদিন শুধু একটিই ধ্বনি - জয় বাংলা।

এ খবর পাকিস্তান সরকারের কানে যেতে সময় লাগে নি। সেদিন দুপুর থেকেই বার বার ‘শো কজ’-এর জন্যে ডাকা হয় রকিবুলকে। পরদিন গণমাধ্যমে ছবিসহ এই ঘটনা ছাপা হলে চারিদিকে হইচই পড়ে যায়। প্রতিবাদের এই অনন্য নজির এমনকি ব্রিটিশ গণমাধ্যমেও স্থান করে নেয়।

দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায় রকিবুলের ‘জয় বাংলা’

এখানেই ঘটনার শেষ নয়। ম্যাচের চতুর্থ দিন, পহেলা মার্চ যখন জানা গেল ন্যাশনাল এসেম্বলি বাতিল হয়েছে- বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরে গোটা স্টেডিয়ামে। জ্বালানো হয় আগুন। প্রতিবাদের মুখে পন্ড হয় ম্যাচ। এই স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদের ইন্ধন যে জুগিয়েছিল রকিবুলের সেই সাহসী সিদ্ধান্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ক্রিকেট ব্যাট হাতে এভাবেই প্রতিবাদের বীজ বুনে দিয়েছিলেন রকিবুল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’-এর আদলে ‘স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দল’ গড়ার কাজও করছিলেন তিনি।

একাত্তরে ১৮ বছরের তরুণ ছিলেন আজকের এই রকিবুল হাসান

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সেই স্বাধীন দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন রকিবুল। দারুণ ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। তবে ক্রিকেটীয় কীর্তি ছাপিয়ে ওই ‘জয় বাংলা’ স্টিকারের বীরত্বে তিনি আরও বেশি উজ্জ্বল। খেলার মাঠ থেকে রনাঙ্গনে প্রতিবাদের হাতিয়ার করেছেন তাঁর ব্যাট কে। খেলার মাঠে দেশপ্রেম ও সাহসিকতার এমন নজির রকিবুল হাসানের মতো আর ক’জন দেখাতে পেরেছেন?

 

মন্তব্য করুন: