শরণার্থী ক্যাম্প থেকে ফুটবলের মাঠে

২৪ মার্চ ২০২৩

শরণার্থী ক্যাম্প থেকে ফুটবলের মাঠে

স্পোর্টস ওয়েবসাইট 'দ্য অ্যাথলেটিক' এর  হিসেবে বলছে, শুধু এবারের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগেই ২৪ জনের বেশি ফুটবলার আছেন, যাঁরা একসময় ছিলেন শরণার্থী। ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল মাতানো অমন পাঁচ শরণার্থী ফুটবলারের গল্পই এখানে।

লুকা মদরিচ।  ছবি: সংগৃহীত লুকা মদরিচ 

লুকা মদরিচের জন্ম ১৯৮৫ সালে ক্রোয়েশিয়ায়। মদ্রিচি গ্রামে দাদা-দাদির সঙ্গে কাটছিল শৈশব। ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সার্ব বিদ্রোহীরা মদরিচের দাদাকে হত্যা করে। পুড়িয়ে দেয় তাদের বাড়ি। পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পুরো পরিবার।

এরপর জাদার শহরের হোটেলে শুধু শরণার্থী জীবন। হোটেল সংলগ্ন গাড়ি রাখার জায়গায় শুরু মদরিচের ফুটবল নিয়ে অধ্যবসায়। সেই তিনিই অনেক অনেক বছর পর ক্রোয়েশিয়ার মতো ছোট্ট এক দেশকে ২০১৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে নিয়ে যান। বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন। মেসি-রোনালদোর তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময়ে তাঁদের ছাপিয়ে জেতেন ফিফা বর্ষসেরা, ব্যালন ডি’অর। ক্লাব  রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ, লিগ, ক্লাব বিশ্বকাপের সাফল্যে ভাসেন।

কিশোর বয়সের শরণার্থী মদরিচ কার পার্কিংয়ে ফুটবল খেলতে খেলতে কি এতটা ভাবতে পেরেছিলেন!

এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা।  ছবি: সংগৃহীত এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা

রিয়াল মাদ্রিদে মদরিচের সতীর্থ আরেক মিডফিল্ডার এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা। ২০০২ সালে অ্যাঙ্গোলার কাবিন্দার একটি শরণার্থী ক্যাম্পে তাঁর জন্ম। বাবা-মা কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের। কামাভিঙ্গার বয়স যখন ২ বছর, তখন পুরো পরিবার চলে যায় ফ্রান্সে।

পরে ফ্রান্সে এক ফুটবল ক্যাম্পে স্কাউটদের নজর কাড়েন কামাভিঙ্গা। রেঁনেতে ক্যারিয়ার শুরুর পর চলে যান রিয়াল মাদ্রিদে। সেখানে এরই মধ্যে জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। ফ্রান্সের হয়েও শতাব্দীর সর্বকনিষ্ট গোলদাতা তিনি।

তবে সাফল্যের ঝলমলে আলোতেও কামাভিঙ্গা ভোলেননি শরণার্থী জীবনের সেই অতীত অন্ধকার। তাই তো বলতে পারেন, ‘আমি ফুটবল খেলতে পেরে কৃতজ্ঞ। একজন প্রাক্তন শরণার্থী হিসাবে এটি করতে পেরে গর্বিত।’

আলফনসো ডেভিস।  ছবি: সংগৃহীত আলফনসো ডেভিস

লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে ঘানার শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় আরও অনেক পরিবারের মতো সেই পরিবারটিও। সেখানেই জন্ম আলফোনসো ডেভিসের। তাঁর বয়স যখন ৫ বছর, পুরো পরিবার চলে যায় কানাডায়। সেখানে পরবর্তীতে প্রতিভাবান এই ফুটবলার 'ফ্রি ফুটি' নামে এক প্রতিযোগিতায় নাম লেখান। এই লিগে তাঁরাই খেলতে পারতন, যাঁদের নিবন্ধন ফি, পরিবহন খরচ এবং খেলার জন্যে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি কেনার সামর্থ্য ছিল না।

২০১৭ সালের জুন মাসে নাগরিকত্ব পাবার এক সপ্তাহ পর কানাডা জাতীয় দলে অভিষেক ডেভিসের। মাত্র ১৬ বছর বয়সে। বর্তমানে বিশ্বসেরা লেফট ব্যাকদের মধ্যে ধরা হয় ডেভিসকে। ক্লাব ফুটবলে খেলছেন বায়ার্ন মিউনিখে। ডেভিসই প্রথম কানাডিয়ান ফুটবলার, যিনি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন।

আওয়ার মাবিল।  ছবি: সংগৃহীত আওয়ার মাবিল

বাবা-মা বর্তমান দক্ষিণ সুদানের। দ্বিতীয় সুদান গৃহযুদ্ধের সংঘাত থেকে বাঁচতে বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেন তাঁরা কেনিয়ার কাকুকা শরণার্থী ক্যাম্পে। সেখানে ১৯৯৫ সালে জন্ম নেন আওয়ার মাবিল। একটু বড় হলে মোজা পাকিয়ে ফুটবল বানিয়ে খেলা শুরু তাঁর।

২০০৬ সালে পুরো পরিবার অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। সেখানেই মাবিলের পেশাদার ফুটবলার হয়ে ওঠা। অ্যাডিলেড ইউনাইটেডে খেলা শুরু করেন। ২০১৮ সালে অভিষেক অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে। 

মাবিলের গোলেই ‘সকারু’রা ২০২২ কাতার বিজীবশ্বকাপ টিকিট নিশ্চিত করে। সে সময় অতীতের কথা মনে করেই তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পরিবারের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়াকে ধন্যবাদ জানানোর এটাই একমাত্র উপায়।’ 

ভিক্টর মোজেস।  ছবি: সংগৃহীত ভিক্টর মোজেস

১৯৯০ সালে নাইজেরিয়ার কাদুনাতে জন্ম ভিক্টর মোজেসের। তাঁর বয়স যখন মাত্র ১১ বছর, সে সময় এক ধর্মীয় দাঙ্গায় মারা যান বাবা-মা। স্থানীয় এক ফুটবল ম্যাচ চলার সময়ে মোজেস এই খবর জানেন। এরপর ইংল্যান্ডে পালিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত বন্ধুদের আশ্রয়ে লুকিয়ে ছিলেন। 

দক্ষিণ লন্ডনের একটি পরিবার মোজেসকে লালন-পালন করেন। সেখানেই তাঁর পেশাদার ফুটবলে পথচলা শুরু। ক্রিস্টাল প্যালেসে শুরু করে চেলসি, লিভারপুল, ইন্টার মিলানের মতো ক্লাবে খেলেছেন এই উইঙ্গার। জাতীয় দল হিসেবে অবশ্য মাতৃভূমি নাইজেরিয়াকেই বেছে নেন মোজেস।

শরণার্থী থেকে খেলোয়াড় হবার গল্প নতুন নয়। ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিসসহ আরও অনেক খেলায় শরণার্থীরা নিজেদের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। জীবনসংগ্রামে জয়ী হবার পাশাপাশি খেলার মাঠেও হয়েছেন বিজয়ী। হয়েছেন অন্য অনেকের অনুপ্রেরণার গল্প।

মন্তব্য করুন: