এই শতাব্দীর সেরা ১০ ফুটবল কোচ

এই শতাব্দীর সেরা ১০ ফুটবল কোচ

মাঠে তো খেলেন ফুটবলাররাই। তবুও ফুটবল মূলত কোচের খেলা। 

তা এই শতাব্দীর সেরা ১০ কোচের তালিকার করলে সেখানে থাকবেন কারা? ফুটবল বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘গোল ডটকম’ অমন এক তালিকা করেছে। চলুন নামগুলো এবং তাঁদের অবস্থান দেখে নেয়া যাক।

আন্তনিও কন্তে১০. আন্তনিও কন্তে

কোনও এক ক্লাবের দায়িত্ব নেবার সঙ্গে সঙ্গেই সাফল্য – এটাই যেন আন্তনিও কন্তে। দু-একটা ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। তবে জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান এবং চেলসির মতো বড় ক্লাবের হারানো গৌরব তাৎক্ষণিকভাবে ফেরানোর কৃতিত্বও অবশ্যই কন্তের।

তাঁর ক্যারিয়ারের কালো দাগ বলতে, বাজে ইউরোপীয় রেকর্ড। তাঁর অধীনে ইন্টার ২০২০ ইউরোপা লিগের ফাইনালে সেভিয়ার কাছে হারে। পরে চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্রুপ পর্ব থেকেও বিদায় নেয়। একই ঘটনা ২০১৩-১৪ মৌসুমের জুভেন্টাসের। কন্তে কখনই তাঁর দল নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল পেরোতে পারেননি।

তবে ইতালিয়ান সিরি ‘এ’ এবং ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ – ইউরোপের বড় দুই লিগে কন্তের ৫টি লিগ শিরোপা জয়ের রেকর্ড ঈর্ষণীয়।

লুইস এনরিকে৯. লুইস এনরিকে

খেলোয়াড় হিসেবে লুইস এনরিকে ছিলেন আপোষহীন এবং একজন লড়াকু। কোচ হিসেবেও তেমনই। পেপ গার্দিওলার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রথমে বার্সেলোনার হয়ে খেলেন। এরপর রিজার্ভ দলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শেষে মূল দলের। আর সেই বার্সেলোনার কোচ হিসেবে জিতেছেন সম্ভাব্য সব শিরোপা।

তাতা মার্তিনোর কাছ থেকে দুর্বল এক বার্সাকে পেয়েছিলেন এনরিকে। তবে সে দলে ছিলেন লিওনেল মেসি, জাভি এর্নান্দেজ, জেরার্দ পিকে, সের্হিয়ো বুশকেৎজের মতো ফুটবলার। নতুন করে আসেন নেইমার, লুইস সুয়ারেজ। গড়ে ওঠে একটি দুর্দান্ত দল। 

এনরিকের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত ছিল সম্ভবত ২০১৫ সালে মেসির সঙ্গে দ্বন্দ্ব বড় হতে না দেয়া; সেটি মিটিয়ে ফেলা। এর পাঁচ মাস পরেই অবিশ্বাস্য সফলতা পায় বার্সা। লা লিগা, কোপা দেল রে এবং চ্যাম্পিয়নস লিগের ত্রিমুকুট জেতে দলটি। পরে আরও একটি লিগ ও দুটি কোপা দেল রে জেতেন। স্পেনের কোচ হিসেবে অবশ্য ততটা সাফল্য পাননি এনরিকে।

ভিসেন্তে দেল বস্ক৮. ভিসেন্তে দেল বস্ক

ভিসেন্তে দেল বস্ক মাত্র সাড়ে তিন মৌসুম রিয়াল মাদ্রিদের কোচ ছিলেন। এই অল্প সময়েই জেতেন দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং দুটি লা লিগাসহ সাতটি ট্রফি। পরবর্তীতে আট বছর ছিলেন স্পেন জাতীয় দলের দায়িত্বে। এ সময় স্পেন জিতেছে বিশ্বকাপ এবং ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ। 

কিন্তু দেল বস্ক কখনোই তার প্রাপ্য সম্মান পাননি। ২০০৩ সালে দ্বিতীয় লিগ শিরোপা জয়ের পরের দিন মাদ্রিদের কোচের পদ থেকে তাঁকে  বরখাস্ত করা হয়। 

মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ সেই সময়ে বলেছিলেন, দেল বস্কের কোচিং পদ্ধতি গতানুগতিক। তবে এরপর  মাদ্রিদের আরেকটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে আরও ১১ বছর লেগেছিল। সম্ভবত দেল বস্কের সেই গতানুগতিক পদ্ধতি ততটা খারাপ ছিল না।

দিয়েগো সিমিওনে৭. দিয়েগো সিমিওনে

আতলেতিকো মাদ্রিদের কোচ হিসেবে দিয়েগো সিমিওনে ১১ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন। ক্লাবকে এনে দিয়েছেন সাফল্য। 

সিমিওনের অধীনে আতলেতিকো ১১ মৌসুমেই লা লিগার পয়েন্ট টেবিলে শীর্ষ তিনের মধ্যে ছিল। দুবার তো শিরোপাই জিতেছে। এছাড়াও এই সময়ে তারা দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছে। দুটি ইউরোপা লিগ এবং একটি কোপা দেল রে জিতেছে।

খ্যাপাটে এই আর্জেন্টাইন কোচকে অবশ্য শুরু ট্রফি দিয়ে বিবেচনা করলে হবে না। তিনি আতলেতিকোকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছেন। যাঁরা এখন মহাদেশের অন্যতম সেরা স্টেডিয়ামে খেলে। ফুটবলে যেখানে কোনও কোনও ক্লাব এক মৌসুমে তিনবারও কোচ বদলায়, তখনও আতলেতিকো ভক্তদের ‘ওলে ওলে ওলে, চোলো সিমিওনে’ স্লোগান অপরিবর্তনীয়। 

জোসে মরিনিয়ো৬. জোসে মরিনিয়ো

এই পর্তুগিজ অনেক কিছুই জিতেছেন। এবং তা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে কখনও ক্লান্ত হন না জোসে মরিনিয়ো। 

যদিও ২০১৭ সাল থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু জিততে পারেননি। তবে মরিনিয়োর চাহিদা কখনও কমেনি। এমনকি পিএসজির পরবর্তী কোচ হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সেই ২০০৪ সালে চেলসির কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই যে নিজেকে ‘স্পেশাল ওয়ান’ ঘোষণা দিয়েছেন, এরপর থেকেই মরিনিয়োর উপর থেকে চোখ সরানোর উপায় নেই।

যদিও তিনি হয়তো সেরা সময়টা পেছনে ফেলে এসেছেন। এরপরও মরিনিয়োর রেকর্ড অসামান্য। পোর্তো ও ইন্টার মিলানের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়। পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, স্পেন এবং ইতালিতে ৮টি লিগ শিরোপা। রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, টটেনহাম ও রোমার মতো দলকে কোচিং করানো। অসাধারণ এক ক্যারিয়ারই ‘স্পেশাল ওয়ান’ মরিনিয়োর। 

জিনেদিন জিদান৫. জিনেদিন জিদান

সমালোচকরা কোচ জিনেদিন জিদানকে ভাগ্যবান বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু শুধু ভাগ্য দিয়ে এত সাফল্য সম্ভব নয়। ভাগ্য কাউকে টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, দুটি লা লিগা শিরোপা জেতাতে পারে না। 

এটি ঠিক যে, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে সেরা সময়ে পেয়েছিলেন জিদান। কিন্তু তা পেয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের তাঁর আগের কোচ রাফায়েল বেনিতেজ, ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি এবং জোসে মরিনিয়োরাও। জিদানের সাফল্যের ধারকাছেও তো দলকে নিয়ে যেতে পারেননি। 

আর রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হিসেবে প্রত্যাশার চাপের ব্যাপারটিও তো আছে। মিডিয়ার চাপ, সমর্থকদের চাপ, ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের মতো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মানিয়ে নেবার চাপ। জিদান সেগুলো খুব ভালোভাবে সামলেছেন। রিয়াল মাদ্রিদকে এনে দিয়েছেন সাফল্য।

২০১৮ তে যখন তিনি দায়িত্ব ছাড়েন প্রথমবার। তখন ক্লাবটি এমনভাবে ভেঙে পড়েছিল যে, ১০ মাস পর জিদানকে আবার ফিরিয়ে আনে। 

ইয়ুর্গেন ক্লপ৪. ইয়ুর্গেন ক্লপ

"আমি হেভি মেটাল মিউজিক পছন্দ করি। আর সবসময় তা উচ্চস্বরে চাই" -- ২০১৩ সালে ইয়ুর্গেন ক্লপ বলেছিলেন। এক দশক পরেও তাঁর দলের ফুটবলে রয়ে গেছে সেই প্রতিফলন। লিভারপুল ভক্তরা চাইবেন না, তাঁদের ক্লাবের এই হেভি মেটাল মিউজিকের ফুটবল বন্ধ হোক। 

এই জার্মান কোচ ক্লপ দুটি ঘুমন্ত দৈত্যকে যেন জাগিয়ে তুলেছেন। প্রথমে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড এবং এরপর লিভারপুল। দুটি ক্লাবকেই জয়ের মেশিনে পরিণত করেছেন তিনি। তাঁর হাই প্রেসিং, বিদ্যুৎগতির ডর্টমুন্ড ইউরোপীয় ফুটবলে ঝড় তুলেছিল। বায়ার্ন মিউনিখকে পেছনে ফেলে বুন্দেসলিগা শিরোপা জিতেছিল দুবার। উঠেছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালেও।

এরপর ক্লাপ ''গেগেনপ্রেসিং'' ফুটবল নিয়ে আসেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। লিভারপুলের লিগ শিরোপার ৩০ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটান। মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে আরও দুটি শিরোপা জয় হাতছাড়া হয় তাঁদের। তিনি ‘অল রেড‘দের তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে নিয়ে গেছেন। একটিতে জিতেছেন।

কার্লো আনচেলত্তি৩. কার্লো আনচেলত্তি

কার্লো আনচেলত্তির রেকর্ডই তাঁর সেরা হবার কারণ জানিয়ে দেয়। তিনিই একমাত্র কোচ, যিনি ইউরোপের শীর্ষ পাঁচটি লিগের প্রতিটিতে শিরোপা জিতেছেন। জিতেছেন ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ। রিয়াল মাদ্রিদে তার প্রথম স্পেলে, তাকে একবার ‘নমনীয়’ কোচ হিসেবে এক রকমের অভিযুক্ত করা হয়েছিল। আনচেলত্তির প্রতিক্রিয়া ছিল নিখুঁত, “এই নমনীয় হয়েই তো আমি তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছি।” সংখ্যাটা এখন চার।

ফুটবলার হিসেবেও দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন আনচেলত্তি। কোচ হিসেবে এসি মিলান ও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দুটি করে চারটি। সফল কোচের সেরা তিনে এই ইতালিয়ানকে না রাখলে হয়!

স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন২. স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন

১৯৯৩ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ২৬ বছর পর লিগ শিরোপা জেতান স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। আর তাঁর বিদায়ের পর ক্লাবের যে অবস্থা, আবার লিগ জিততে আরও ২৬ বছর লেগে যেতে পারে। 

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ২৭ বছর ফার্গুসন ‘রেড ডেভিল’দের ১৩টি লিগ শিরোপা, পাঁচটি এফএ কাপ এবং দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়েছেন। এমনকি কেবল এই শতকের রেকর্ড বিবেচনায়ও তালিকার বেশিরভাগ কোচের চেয়ে তাঁর সাফল্য বেশি। 

ফার্গুসনের অন্যতম অর্জন লিভারপুলকে পেছনে ফেলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ইংলিশ লিগের সফলতম ক্লাব হিসেবে রেকর্ড বইয়ে তুলে আনা। তাঁর ক্লাব ছাড়ার এক দশক পরে ইউনাইটেডকে দেখলে এখন পাল ছাড়া দিশেহারা নৌকাই মনে হয়।

পেপ গার্দিওলা১. পেপ গার্দিওলা

পেপ গার্দিওলা যে ক্লাবে গিয়েছেন, সেখানকার ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি ১২টি মৌসুমে ১০টি লিগ শিরোপা জিতেছেন। স্প্যানিশ লা লিগা এবং ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে মোট পয়েন্টের রেকর্ড ভেঙেছেন। সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে জার্মান বুন্দেসলিগা শিরোপা জিতেছেন।

গার্দিওলা কখনও তাঁর খেলোয়াড়দের আত্মতুষ্ট হতে দেন না। এবং তিনি ক্রমাগত উদ্ভাবন করছেন; নতুন নতুন কৌশল নিয়ে আসছেন। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ম্যানচেস্টার সিটিতে বেশিরভাগ সময় তিনি যেমন কোনও সেন্টার ফরোয়ার্ড ছাড়া দলকে খেলিয়েছেন। কিন্তু আর্লিং হলান্ডকে কেনার পর ম্যানসিটির খেলার ধরনই পাল্টে দেন গার্দিওলা। আর ওই নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকার কেমন খেলছেন, তা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছেন।

গার্দিওলা কি সর্বকালের সেরা কোচ? অনেকে মানবেন; অনেকে মানবেন না। বিশেষত বার্সেলোনার হয়ে দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর আর ইউরোপসেরা না হওয়াটা গার্দিওলার সঙ্গে ঠিক মেলে না। 

হ্যাঁ, বেশ কয়েকবার তিনি কাছাকাছি গিয়েছেন। একটুর জন্য হেরেছেন বেশ কিছু নকআউট টাই। এবার আবার সুযোগ আছে। আর ১২ মৌসুম কোচিংয়ে স্পেন, জার্মানি, ইংল্যান্ডে ১০ লিগ শিরোপা গার্দিওলার গ্রেটনেস প্রমাণ করে।

মন্তব্য করুন: