রাজা না হয়েও মিশরের রাজা সালাহ
২৭ এপ্রিল ২০২৩

নাগ্রিগ। মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে ৮০ মাইল মাইল দক্ষিণে ছোট্ট এক মফস্বল এলাকা। শহরতলীর এ অঞ্চলের নেই আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য। ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি আর পলেস্তারা খসা দেয়ালে দেয়ালে দারিদ্র্যের ছাপ ছিল স্পষ্ট।
অখ্যাত এ অঞ্চলের এক পরিবারে জন্ম ফুটফুটে ছেলেটির। বাবা-মা আদর করে ডাকেন মোমো। এই নাগ্রিগ শহর পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়ে ওঠে মোমো নামের সেই ছেলেটির কল্যাণে। এলাকার পরিচয়ে মানুষের মুখে মুখে একটাই কথা ভেসে বেড়ায়, ‘ভিলেজ অব দ্য ইজিপশিয়ান কিং অর্থাৎ ‘এটা মিশরের রাজার গ্রাম’!
একবিংশ শতাব্দীতে মিশরের সেই রাজাই মোহামেদ সালাহ। পিরামিডের দেশ মিশরকে এখনকার মানুষ সবচেয়ে বেশি চেনে সালাহর দেশ হিসেবে।
ফুটবলের প্রতি সালাহর আকর্ষণ ছোটবেলা থেকেই। রাস্তায়, মাঠে বন্ধুদের সাথে বলে লাথি মেরে মেরে কেটেছে শৈশব-কৈশোর। ফুটবলের প্রতি টান এতটাই যে, নাওয়া-খাওয়ার কথাও ভুলে যেতেন। গৃহিণী মা অলিগলি ঘুরে ছেলেকে খুঁজে ঘরে নিয়ে আসতেন।
পড়ালেখা ফাঁকি দিয়ে শুধু খেলায় মেতে থাকলে যে কোনো পরিবারেই বাধার মুখে পড়তে হয় শিশুদের। সালাহর ক্ষেত্রে অবশ্য তা হয়নি। কেননা পরিবারে তিনিই একমাত্র ফুটবলার নন। বাবা-চাচাও যে বয়সভিত্তিক ফুটবল খেলেছেন এক সময়।
সালাহর ফুটবল আসক্তি দেখে তাই পরিবার থেকে বড় বাধা আসেনি। বড় ভাই আর বন্ধুদের সাথে নাগ্রিগের পথেঘাটে আর স্কুল মাঠে ফুটবল খেলেই কাটতে থাকে ছেলেবেলা।
শৈশবে বাড়ি থেকে আধ ঘন্টা দূরের এক ক্লাবে নাম লেখান সালাহ। সেই থেকে শুরু আনুষ্ঠানিক ফুটবল অনুশীলন। কিছুদিন পর যোগ দেন আরও দূরের এক ক্লাবে। কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও-বা কয়েকবার বাস বদলে যেতে হত সেখানে। তবুও থামেননি সালাহ।
আর ভাগ্য বদলের লটারির টিকেটও পেয়ে যান অচিরে।
মিশরের বড় ক্লাব আরব কন্ট্রাক্টরস এফসি। সালাহর বয়স যখন চৌদ্দ বছর, তখন তার স্কুলে এই ক্লাবের পক্ষ থেকে পেপসি লিগ ফুটবলের আয়োজন করা হয়।
সেখানে সালাহর খেলা দেখে মুগ্ধ কন্ট্রাক্টরস-এর কর্তারা। দলে টেনে নেয় তাঁকে। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় সালাহর।
তবে আরব কন্ট্রাক্টরস এ খেলতে গিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় সালাহকে। কখনও বাবার হাত ধরে, কখনও-বা একাই পাঁচবার বাস বদলে আসা যাওয়া করতে হত।
পরবর্তীতে এ পরিশ্রমই রূপান্তরিত সালাহর পায়ের ফুটবল যাদুতে!
আরব কন্ট্রাক্টরসে থাকাকালীন মিশরের প্রিমিয়ার লিগে অভাবনীয় সাফল্য পায় দলটি। ক্লাবটিতে সালাহর খেলা দেখে মুগ্ধ হয় সুইজারল্যান্ডের ক্লাব বাসিল। ২০১২ সালে বিশ বছর বয়সের সালাহকে কিনে নেয় তারা।
সেই প্রথম সালাহর ইউরোপ যাত্রা।
অবশ্য বাসিলে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া সহজ ছিল না। দেশ-মহাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে বেগ পেতে হয়েছে শুরুতে। মানিয়ে নেবার পর ঝলসে ওঠেন সালাহ।
বাসিলের সহকারী কোচ হেইকো ভোগেলের মতে, সালাহ একজন ‘স্লো বার্নার’। অর্থাৎ সালাহ কোনো আতশবাজি নন যিনি মুহুর্তে জ্বলেই আবার নিভে যান। বরঞ্চ তিনি হলেন সেই বারুদ, যিনি জ্বলে ওঠেন ধীরে এবং জ্বলতেই থাকেন।
স্বপ্নের মত দুটি মৌসুম কাটে প্রথম ইউরোপ যাত্রায়। দুই মৌসুমেই বাসিলের হয়ে সুইস প্রিমিয়ার লিগে শিরোপা জেতেন সালাহ। চ্যাম্পিয়নস লিগেও দেখান প্রতিভার ঝলক।
এরপরই চেলসি। ১১ মিলিয়ন ইউরোর সেই চেলসি-যাত্রা সালাহর ক্যারিয়ারে হতাশা হয়েই আসে। কোচ হোসে মরিনিয়ো প্রথম একাদশে রাখার মত যোগ্য ভাবেননি সালাহকে। ইংলিশ ক্লাবটিতে ১ বছরে ম্যাচ খেলতে পারেন মাত্র ১৯ টি।
এরপর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সালাহর গন্তব্য লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির শহর ফ্লোরেন্স; চেলসি থেকে ধারে যোগ দেন ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্তিনায়।
সালাহর গতি, ড্রিবলিং আর বাঁ পায়ের জাদুতে বিমোহিত হন ফ্লোরেন্সবাসী। দ্রুতই হয়ে যান সমর্থকদের নয়নের মণি। একের পর এক গোল করে এবং করিয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেন তিনি।
পরের মৌসুমে ফিওরেন্তিনা কিনে নিতে চায় সালাহকে। চেলসি রাজি হয় না। ধারে যোগ দেন আরেক ইতালীয় ক্লাব এ এস রোমায়। রোমায় প্রথম মৌসুমে ৪২ ম্যাচে ১৫ গোল আর ৯ অ্যাসিস্ট তাঁর।
ধার থেকে সালাহকে কিনে নেয় রোমা। এই মিশরীয় জাদুকর যোগ দেয়ার আগের মৌসুমে যেখানে রোমার দলীয় গোল ছিল ৫৪টি, সালাহ যোগ দেয়ার পরের দুই মৌসুমে তা হয় যথাক্রমে ৮৩ এবং ৯০।
সালাহর খেলায় আছে গতি। চোখের পলকে অবস্থান পরিবর্তন করে যে কোনও দলের প্রতিরক্ষা ভেঙে দিতে পারেন চোখ ধাঁধানো ড্রিবলিংয়ে। রোমায় এসে ধীরে ধীরে ফিনিশিংয়েও উন্নতি করেন তিনি।
এরপর দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড জয়ের সুযোগ। তবে এবার নীল জার্সিতে নয়। দলবদলের বাজারে রেকর্ড দামে তাকে কিনে নেয় লিভারপুল। ইপিএলে নিজেকে চেনানোর জন্য যেন মরিয়া হয়ে ওঠেন সালাহ।
ইপিএল প্রত্যাবর্তনে লিভারপুলের জার্সিতে অভিষেকেই করেছেন গোল। এরপরের ইতিহাস শুধুই অর্জনের। এনফিল্ডে ফেরার মৌসুমে লিভারপুল লিগ না জিতলেও ৩৬ ম্যাচে ৩২ গোল করে প্রিমিয়ার লিগের গোল্ডেন বুট জয়ী সালাহ। প্রিমিয়ার লীগের সেরা খেলোয়াড়সহ আরও অনেক অর্জনই আছে তাঁর।
এরপর একে একে লিভারপুলের হয়ে সালাহ জেতেন চ্যাম্পিয়নস লিগ, উয়েফা সুপার কাপ এবং ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ। আর এত অর্জনের মাঝে সব থেকে আলাদা দীর্ঘ ৩০ বছর পর লিভারপুলের প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা।
ক্লাব ক্যারিয়ারের মত জাতীয় দলেও অনেক অর্জন সালাহর।
২০১৭ ও ২০১৮ সালে দুইবার বর্ষসেরা আফ্রিকান খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে আফকন কাপে তাঁর নৈপুণ্যে রানার্সআপ হয় মিশর।
আর ২৮ বছর পর মিশর বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায় ২০১৮ সালে। সেখানেও বড় ভূমিকা সালাহর। বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচের শেষ সময়ে পেনাল্টি থেকে গোল করে মিশরকে নিয়ে যান বিশ্বকাপে। তৈরী হয় ইতিহাস।
ক্লাব ক্যারিয়ারের অর্জন তাকে বিখ্যাত করেছে। আর জাতীয় দলের বীরত্ব তাকে তৈরি করেছে মিশরের একজন মহানায়কে।
মিশরের সাধারণ মানুষ এখন তাই সালাহর নামে খুঁজে পায় অনুপ্রেরণা।
ফুটবলের বাইরে সমাজসেবায়ও খুব সক্রিয় সালাহ। সাধ্যমত চেষ্টা করছেন নিজের গ্রামের উন্নতিতে। কাজ করছেন পিছিয়ে পড়া নারী ও শিশুদের জন্য। তৈরী করেছেন স্কুল। ফুটবলারদের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন স্টেডিয়াম।
মিশরের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে ওঠে আসা স্বল্পভাষী, বিনয়ী একজন সালাহ। ফুটবলার যত বড়, মানুষ হিসেবেও এর চেয়ে কম বড় নন তিনি। এ কারণেই মিশরের মানুষ তাঁকে এত ভালোবাসেন। এ কারণেই মোহামেদ সালাহ রাজা না হয়েও ‘মিশরের রাজা’।
মন্তব্য করুন: